প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার জরুরি
করোনা মহামারি কালীন অলস সময়ে বাংলাদেশে পাবজি, ফ্রি-ফায়ারের মতো বিপজ্জনক গেমসে আসক্ত হয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম; বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেরা। পাড়ার মোড়ে মোড়ে, ব্রিজের উপর, বাঁশ তলায় জটলা পেকে নেশাগ্রস্থ ধরনের অবস্থা। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আদালতে বারান্দায় গিয়ে পৌঁছেছে। আদালত নির্দেশ জারি করায় বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেয় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)।
বিপরীতে চলেছে নানা মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শুধুমাত্র যে গেমসে আসক্তি বা নেতিবাচকতা প্রকাশ পাচ্ছে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব থেকে শুরু করে সব ধরনের অনলাইন ব্যবহারে একরকমের সামাজিক বিশৃঙ্খল আবহ।
আদালতের নির্দেশে অবিভাবকদের বেশিরভাগ অংশ সন্তুষ্ট হয়েছেন। অভিমান করেছেন তরুণ অংশটা। ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও- হঠাৎ করে প্রায়োগিক অর্থে যে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এটা কারো মাথায় নেই। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া বয়ঃসন্ধিকালের একজন তরুণ অকস্মাৎ যে ধাক্কাটা খাবে তার নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। সত্যি বলতে পুরোপুরি বন্ধ করার সক্ষমতা কি আমাদের আছে? কারণ ইতোমধ্যে প্রযুক্তি দুনিয়ায় দক্ষ হওয়া কেউ কেউ ভাবছেন ভিপিএন ব্যবহারের।
পর্ণ এবং অপরাধমূলক নানান বিষয়ে তরুণ প্রজন্ম জড়িয়েছে ব্যাধির ন্যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় নারী বিদ্বেষ, ঠাট্টাতামাসা এবং আক্রমনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি পৌঁছেছে চরমে। সংবাদমাধ্যমগুলোকে বাধ্য হয়েই অনেক সময় মন্তব্য সেকশন বন্ধ রাখতে হয়। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে সন্ত্রাস কার্যক্রম পরিচালনাও। এমনকি জঙ্গিরা তাদের উগ্রবাদী আদর্শ ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করছেন ফেসবুকের মতো প্লাটফর্ম।
প্রতারণামূলক এমএলএম ব্যবসায়ের প্রচারণাও হয় এখানে। খ্যাতি অর্জনের অসুস্থ নেশায় অপরিচিত তরুণ-তরুণীরা টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে শিকার হয়েছেন দলবদ্ধ ধর্ষণের।
আমাদের ৯৯ ভাগ ইয়াং জেনারেশনের হাতে হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল। উঠতি বয়সি এর ভেতরে প্রায় অর্ধেকে। এইট-নাইনে পড়ুয়ারা মোবাইল পেতে অনেক সময়ে নানা অজুহাতে পরিবারকে বাধ্য করে। করোনা মহামারির সময়ে অনলাইনে ক্লাস করণের জন্য বাধ্য হয়েই দিতে হয়েছে মোবাইল বা ল্যাপটপ। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটেছে বহুলাংশে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অন্যদিকে ছাত্রের মনোযোগী উপলব্ধি করেছেন খোদ শিক্ষকেরা। যার আসক্ত চিত্র ভেসে আসছে সংবাদমাধ্যমেও।
অনলাইন ব্যবহারকারী তরুণদের ঘুমের হার অনিয়মিত। প্রয়োজন মতো বা সময় মাফিক ঘুম নেই কারো। কেউ রাত এগারোটা নাগাদ, কেউ রাত বারটা, কেউ দুইটা, কেউ আবার সারারাত ঘুমায়ই না। দোরিতে ঘুম ত্যাগ করায় সকালের নির্মল বায়ুর উপলব্ধিতা হারায়। তৈরি হয় মানসিক অবসাদ। স্মরণ শক্তি কমে আসে; ধীরগতি হয়ে পরে মস্তিস্ক। নীল সাদা স্কিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকাতে তাকাতে দেখা দেয় চোখের সমস্যা। একভাবে বসার জন্য মেরুদণ্ডে তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা। কমে আসে জাতীয় গড় আয়ু। প্রভাব পরতে বাধ্য অর্থনীতি এবং জাতীয় উৎপাদনে।
অনলাইন জগৎ যে কেবলই অসুস্থতা তৈরি করেছে তেমনটা কিন্তু নয়। অনলাইন পৃথিবীকে এনেছে হাতের মুঠোয়। চোখের নিমিষে সৃষ্টি করেছে গ্লোবাল ভিলেজ। প্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবীর একপ্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে পাওয়া যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডে। চাকরির আবেদন করতে এখন আর পোস্ট অফিসে দৌড়াতে হয় না চাকরি প্রার্থীর।
অপরাধী বা আসামী গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও এসেছে নতুনত্ব। অনলাইন প্রযুক্তি ডাক্তারি সেবা, এম্বুলেন্স, নারী নির্যাতন বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নিয়েছে শক্তিশালী অবস্থান। করোনা দুঃসময়ে আমরা দেখেছি ক্লাস পরীক্ষা গ্রহণে অনলাইনের ভূমিকা। এমনকি অফিস-আদালতের জরুরি কাজকর্ম সারতে হয়েছে অনলাইনে, প্রযুক্তির আওতায়।
আদালতের আদেশে পাবজি, ফ্রি ফায়ার বন্ধ হয়েছে। আগামীতে হয়তো টিকটক, বিগো লাইভ ও লাইকির মতো অ্যাপসহ আরো বেশ কিছু অ্যাপ বন্ধ হবে। এটাই কি চূড়ান্ত সমাধান? তরুণেরা কি বিকল্প পথে হাটতে পারবেন না? যদি বিকল্প পন্থায় এগুলো ব্যবহার করতে পারেন, তবে এই বন্ধতে কি আদৌ কোন লাভ হল! বরঞ্চ উচিত ছিলো কাউন্সেলিং করা, পরিবার এবং সামাজিক পর্যায়ে সজাগ থাকার, সরকারি পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত সচেতন করতে প্রচার প্রচারণার। পরিবেশগত কারণে আমাদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে নিষিদ্ধ বিষয়েই। সেরকম পরিস্থিতিতে জোরজবরদস্তি করে, ভয় দেখিয়ে তরুণদের ফেরানো অসম্ভব।
গ্রাম পাঠাগারগুলো পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। কোন কোন গ্রামে তো পাঠাগারই নাই। অনেক এলাকায় থাকলেও জীর্ণশীর্ণ। অথচ একটি উন্নত জাতির জন্য প্রয়োজন ছিলো বই, বই আর বই। চিন্তার পরিবর্তন আনতে বাগান করার জন্য স্কুল কলেজগুলোতে তাগিদ দেওয়া যেতে পারে। তাগিদ দেওয়া যেতে পারে যোগব্যায়ামে অথবা শরীর চর্চায়। এই বাংলায় উঠতি বয়সি ছেলেদের কাবাডি, গোল্লাছুট এখন অপরিচিত। যে খেলাধুলা মানুষের মনের প্রশান্তি ঘটায় সেগুলোর প্রতি মনোযোগ তরুণদের বিপদ যাত্রা থামানোর একমাত্র পথ।
যে কোনো বিষয় ততক্ষণ পর্যন্তই ভালো যতক্ষণে আসক্ত না হয়, মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার না হয়। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেটা অস্বাভাবিক। প্রযুক্তির এই নেতিবাচকতা থেকে তরুণদের ফেরানো না গেলে আমরা এক বিকলাঙ্গ প্রজন্ম পেতে চলেছি। প্রজন্ম রক্ষার্থে পরিবারের সচেতনতা প্রয়োজন হয়ে পরেছে। সাথে সাথে ইতিবাচকতায় রূপান্তর ঘটতে সরকারের আশু দৃষ্টি আকাঙ্ক্ষিত। এখনই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার জরুরি, সকলের কাম্য।
লেখক: কলামিস্ট, ঢাকা