২১ আগস্ট ২০২১, ২০:৫৭

অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু

জাতির জনক বঙ্গকন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  © ফাইল ফটো

“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” এ শিক্ষা পৃথিবীতে চালু হলে এতো জাত-পাত ভেদ থাকত না। জাত ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারই হলো সাম্প্রদায়িকতা। এ উপমহাদেশ ইংরেজদের ছড়িয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। অবশেষে এর চুড়ান্ত পরিণতিতে দুটো আলাদা দেশ তৈরি হয়ে গেল। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যৌবনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা দেখেছেন, এর প্রতিকারে কাজ করেছেন। দেশভাগের আগমুহূর্তে বাংলা-ভারত ছুটে বেড়িয়েছেন দাঙ্গা ঠেকাতে। তিনি বলেছেন, “আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১৯১)। বঙ্গবন্ধুর এই চেতনাই হলো আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অনুপ্রেরণা।

আরও পড়ুন: পিতা হারানোর শোক আজ উন্নত স্বদেশ বিনির্মানে শক্তির উৎস

বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলার রুপরেখায় সাম্প্রদায়িকতার কোনো ঠাঁই ছিল না। আসলে ধর্মের কারণে সৃষ্ট হওয়া বিভেদ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা তিনি দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আমরা জানতে পারি, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশ তিনভাগে (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলা) বিভক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে প্রবল সামম্প্রদায়িক বিরোধে জেরে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ঠিকই হল তবে তা ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান নামে। বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হল। বাঙালি জাতির ঐক্য চিরতরে ভেঙে গেল। একই জাতি দুটি দেশের অধীন হল। বাঙালির এ বঞ্চিত হওয়া ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজেডি। তাই বাঙালির একক রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের শুরুর মুহূর্তে রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সকলকে সাবধান করে বলেন, “মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের।” বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবেই জানতেন বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। ধর্মের নামে তাদের ধোঁকা দেওয়া যত সহজ, অন্য কিছুতে ততটা সহজ নয়। তাই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে ঐ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়েই তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, “বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”

প্রকৃতপক্ষে, কোনো ধর্মই সহিংসতাকে সমর্থন করে না। প্রতিটি ধর্মেরই একমাত্র লক্ষ্য মানবকল্যাণ। কিন্তু কিছু অসৎ মানুষ ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অসছে সবসময়। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সবসময়ই সচেতন ছিলেন। তিনি সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, “ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল-বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না।” (৭ জুন, ১৯৭২/ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া ভাষণ)।

আরও পড়ুন: মহানায়কের মৃত্যু হয় না

প্রতিটি ধর্মের স্বাধীনতার বিশ্বাসী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৯ মে, ১৯৭২ রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে জনসভায় দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধম-কর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।” এ থেকে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হওয়ার যে অনুপ্রেরণা পাই, তা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাঙালি জাতির জনক বঙ্গকন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। মুজিববর্ষে আমাদের অঙ্গীকার হোক তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। যেখানে একে অপরকে ভালাবাসবে, শ্রদ্ধা করবে; সম্মান করবে মানুষ হিসেবে। পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর কথা দিয়েই শেষ করতে চাই, “যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না (১৮ জানুয়ারি, ১৯৭৪/ আওয়ামীলীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণ)”।

রাসেল আহমেদ
কুষ্টিয়া