বহুমুখী সংকটের আবর্তে শিক্ষা
আমার জীবনের একটি বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই। আমাদের গ্রামের একজন কিশোরী তার স্বামী আর পিতর সাথে শহরে হাসপাতাল এসেছে। কিশোরীটি সন্তানসম্ভবা। তার EDD(expected date of delivery) অতিক্রম করেছে। দরিদ্র পরিবার তাই শহরের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি। কিশোরীর বাবা আমার পূর্ব পরিচিত হঠাৎ হাসপাতলের মসজিদে আমার সাথে দেখা। আসরের নামাজের পর সে সবকিছু আমাকে খুলে বলল। নরমাল ডেলিভারির আশায় তারা গ্রামে রেখেছিল। ডেলিভারি নির্দিষ্ট তারিখ অতিক্রম করেছে অনেক আগেই ।তবুও তারা গ্রামেই রেখে ডেলিভারির চেষ্টা করেছিল। সব শেষ ফরিদপুর সদর হাসপাতাল ভর্তি হয়।
চেক আপ করার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে -পানি শুকিয়ে গেছে, বাচ্চা পেটে পায়খানা করেছে, বাচ্চার মাথা উপরের দিকে। মা ও শিশু উভয়ের জীবন ঝুকির মধ্যে। এই মূহূর্তে বাইরে নিয়ে সিজার করতে হবে। আমি তখন কিশোরীর পিতার সাথে আসরের নামাজ আদায় করে হাসপাতালে যাই। কিশোরীর মুখ দেখে বুঝলাম সে খুব উদ্বিগ্ন। সারা দুনিয়ার ভাবনা তার মাথার উপর। প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশনের টাকা, নিজের জীবন, সন্তানের জীবনের চিন্তা তার মুখের উপর দুশ্চিন্তার কালো ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাৎক্ষণিক বাইরে এসে একটা প্রাইভেট হাসপাতালের সাথে কন্টাক্ট করে সিজারের ব্যবস্থা করি। রাত দশটায় আমি তাকে দেখতে যাই।তখন সে অবশে অচেতন। সকালবেলা যখন আবার দেখতে যাই তখন আমাকে দেখেই একটা বিশ্বজয়ী সাফল্যের হাসি দিল। চোখদিয়ে তার আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একটি জিনিস ধ্বংস করাই যথেষ্ট তাহলো শিক্ষা। শিক্ষাহীন জাতি আর এইডস আক্রান্ত রোগীর অবস্থা একই রকম। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির যেমন সমস্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়, সব রোগ এসে হাজির হয়, তেমনি শিক্ষাহীন জাতির মধ্যে জাতিসত্তা রক্ষার ইমিউনিটি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে চারদিক থেকে শত্রু এসে জাতিকে গ্রাস করে ফেলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ বহুমুখী সংকটের আবর্তে। কিছু সংকটের কথা উল্লেখ করা হলো__
১.অটো পাস সমস্যা
২০২০ সালে সরকার এইসএসসি পরীক্ষায় অটো পাস দিয়েছে। আসন্ন পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসির ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা একরকম অটো পাসের মতোই। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে গ্রুপ ভিত্তিক তিন বিষয়ে পরীক্ষা হবে তাও আবার অতিসংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, নমনীয় প্রশ্নে। আর পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে অ্যাসাইনমেন্ট এর ভিত্তিতেই ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এ প্রক্রিয়ার ফলে মেধাবী শিক্ষার্থী যারা কষ্ট করে লেখা পড়া চালিয়ে আসছে তাদের মেধা আর পরিশ্রমের কোন মূল্যায়ন থাকবে না। গরু- গাধা, হাঁস -মুরগি এক ই দরে বিক্রি হবে। এ ফলাফলে মেধাবীরা তৃপ্তির হাসি হাসতে পারবে না। উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রকট সমস্যার সৃষ্টি হবে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে অচিরেই একটি ইমিউনিটি হীন প্রজন্ম সৃষ্টি হবে যারা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে না।
২. বৈষম্য বাড়ছে
এমনিতেই আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। শহরের ধনী ব্যক্তিদের সন্তানেরা যে মানের প্রতিষ্ঠানে, যে মানের শিক্ষকের কাছে ,যে সব সুবিধা পেয়ে থাকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সে মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও সুযোগ-সুবিধা পায় না। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সে বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। ধনী লোকের সন্তানেরা টাকা ব্যয় করে দামি দামি প্রাইভেট টিচার দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে।আর গরিব মানুষের সন্তানেরা না পেয়েছে ক্লাসের সুবিধা , না পেয়েছে ভালো কোন প্রাইভেট শিক্ষক। এসকল বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের প্রতি খেয়াল করে সরকার যদি কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করে তাহলে অগ্রসরমান শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর যদি সরকার অনাগ্রসর শিক্ষার্থীদের দিকে খেয়াল করে কোন নীতিমালা প্রণয়ন করে তাহলে কিছু করে তাহলে অগ্রসর শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বৈষম্য দূর করতে হলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের কোন বিকল্প নেই।
৩. অনলাইন ক্লাস বাস্তবিকপক্ষে অকার্যকর
বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা জরিপ করে অনলাইন ক্লাস এর ব্যাপারে যে ফলাফল দিয়েছে বাস্তবতা হলো তার উল্টো । প্রাইভেট কিছু ইউনিভার্সিটি - মেডিকেল ছাড়া অনলাইনে এখন কোন পড়াশোনাই হচ্ছে না। তার প্রধান কারণ হলো পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকা। পরীক্ষা না থাকলে শিক্ষার্থীরা কখনোই টেবিল মুখি বা পড়ামুখী হয়না ।এজন্য যে করেই হোক পরীক্ষা গুলো চালিয়ে যেতে পারলে অনলাইন ক্লাস ফলপ্রসূ হত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের পাবলিক পরীক্ষা গুলো চালিয়ে গেছে কেবল বাংলাদেশ অটো পাস দিয়ে শিক্ষার ক্ষতি সাধন করেছে। তাই পরীক্ষাগুলো চালিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. ভয়াবহ সেশন জটের কবলে শিক্ষা
করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একনাগাড়ে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকায় ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। যে সকল দেশে আমাদের সে মারাত্মক অবস্থা ছিল তারাও একনাগাড়ে এত লম্বা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখে নি। সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জীবন থেকে দু'টি করে বছর নষ্ট হয়ে যাওয়ার অর্থ ৯ কোটি বছর সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পূর্বেই দুই বছরের সেশন জটে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে মানসিক সমস্যায় ভুগছে ।শিক্ষা ব্যবস্থায় যে রুটিন ছন্দ ছিল ভেঙে খান খান হয়ে গেছে । শিক্ষার ট্রেন টি যেন লাইনচ্যুত হয়ে রাস্তা থেকে পাশের কোন গর্তের মধ্যে পড়েছে। উদ্ধারের তৎপরতা নেই।
৫. ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা আর ফিরে আসবেনা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে দরিদ্র শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কাজের ঢুকে পড়েছে। অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা তাদের কে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ফলে এসকল শিক্ষার্থীরা আর কোনদিন তাদের প্রাণ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফিরে আসবেনা।
৬. মহৎ পেশাকে পরিত্যাগ করণ
শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অনেকে। নন এমপিও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ করছেন কৃষিকাজ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য কেউবা আছেন বেকার।
৭. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
আমাদের দেশের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মানদন্ডে অনেক পিছিয়ে। তদুপরি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হলে আমাদের শিক্ষার মান আরও নিচে নেমে যাবে । ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে পূর্ণ সিলেবাস এর ওপরে সকল বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা গুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে।আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে টিকে থাকতে পারবো না।ফলে ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তি হতে পারবো না।
৮. ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়িরা
বই-পুস্তক সহ শিক্ষা উপকরণ নিয়ে যারা ব্যবসা করতেন দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণ তাদের ব্যবসা পথে বসে গেছে। মেস মালিক, মেস ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।
ই ডি ডি অতিক্রম করা, হাসপাতালে শায়িত, সন্তানসম্ভবা, কিশোরী মায়ের যে সংকটাপন্ন অবস্থায় আমাদের দেশের শিক্ষা অবস্থা যেন একই রকম ।
সংকট উত্তরণ
এসকল বহুবিধ সংকট থেকে শিক্ষাকে উত্তরণের জন্য কিছু প্রস্তাব তুলে ধরতে চাই-
১. স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে , শিক্ষার্থীদের বিভাজন করে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে।
২. অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের কে টিকা দিতে হবে।
৩. সকল প্রকার পরীক্ষা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।
৪. অটো পাসের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হব।
৫. প্রতিষ্ঠান বাৎসরিক ছুটি কমিয়ে আনতে হবে, কর্ম দিবস বাড়াতে হবে।
৬. সামরিক কয়েক বছরের জন্য শিক্ষাবর্ষ নয় মাসে নির্ধারণ করতে হবে যাতে সেশনজট দূর হতে পারে।
৭. চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করতে হবে।
৮. সাময়িক সময়ের জন্য ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৯. জে এস সি এবং পিএসসি পরীক্ষা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
১০. স্নাতক পাশ করার পর সকল শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বেকার ভাতা দিতে হবে।
তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুয়ার খুলে দিয়ে শিক্ষাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করি।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক
কাদিরদী ডিগ্রি কলেজ
বোয়ালমারী ফরিদপুর