পিতা হারানোর শোক আজ উন্নত স্বদেশ বিনির্মানে শক্তির উৎস
মহান স্বাধীনতার অর্জনের চার দশকের নানান চড়াই-উৎরাই আর ভয়ংকর রকমের প্রতিকূলতার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা অতিবাহিতের পর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা তথা আমাদের জাতির পিতাকে সপরিবারে হারানোর নৃশংসতায় পুরো জাতির মনের গভীরে চিরস্থায়ী ক্ষতের যে অবর্ণনীয় শোক বহমান ছিল, আজকের উপস্থিত বর্তমান সময়ে এসে সেই অসহনীয় যন্ত্রনাই এখন অনবদ্য-প্রত্যয়ী-ভিন্নমাত্রিক-গঠনমূলক অগ্রযাত্রায় আপোষহীন উপস্থাপনার এক অতুলনীয় আত্মিক শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে বাঙালী জাতিকে ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার পথে নৈমিত্তিকভাবে সমৃদ্ধ-উন্নত সোনার বাংলা বিনির্মানের পথে এগিয়ে নিচ্ছে অসীম সাহসিকতায় সন্দেহাতীতভাবে। তাই শুরুতেই গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেই কালো রাতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, সুলতানা কামাল-সহ অন্যান্য সবাইকে ।
উনিশশো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট, বাঙ্গালীর ইতিহাসে জঘন্য সেই কালোরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়েই পারতপক্ষে এই বাঙ্গালী জাতি তথা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত তখনকার সদ্য ভূমিষ্ঠ প্রিয় এই বাংলাদেশের মুক্তির সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেইদিনের নিকৃষ্ট সেই দেশি-বিদেশী কুশলীবরা যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল মুজিব হত্যার পর,ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ব্যাক্তিত্বে বিমোহিত হওয়া পৃথিবীর একটি বিরাট অংশ হতবাকও হয়েছিল। এই জঘন্য হত্যাকান্ডের পর সেই সময়কার বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তাৎক্ষনিক মন্তব্যেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। একদিকে আমি যেমন যারপরনাই গর্ববোধ করি স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি বলে, ঠিক তেমনি আমি শুধু ব্যাথিতই হই না বরং প্রচন্ড লজ্জা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে যখন মনে পড়ে আমরাই আমাদের জন্মদাতার খুনি......!!
পঁচাত্তর পরবর্তীতে আমরা সেই নিকৃষ্ট কুশলীবদের সকল ধরনের বাহানা জড়ানো প্রয়াসই আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি বন্দুকের নলে সিংহাসনের মসনদে আরোহন, স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসন ও পুরষ্কৃত করা থেকে শুরু করে প্রিয় ও পবিত্র সংবিধানের উপর নেমে আসা বিষাক্ত শকুনদের হাসফাস করা খামছি। শুধু যেটা দেখেনি,তা হল পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানের প্রচেষ্টা। আশির দশক পর্যন্ত যে ধারাটি অব্যাহত ছিল ।
একাশি সালে মুজিব তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র আর দুঃশাসনের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শনের সাহস জন্মায় দেশের শোষিত-বঞ্চিত-প্রতিহিংসায় জর্জরিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত সমগ্র জাতি। সবার ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হন প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে সামনে রেখে অভিভাবকের ভূমিকায় স্থলাভিষিক্ত করে ঘুরে দাঁড়ায় পুরো বাঙ্গালী জাতি। নানা আন্দোলনের সংগ্রামের মাধ্যমে '৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসীন হন আজকের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা । একাশি সালে দেশে আসার পর পুরো পরিবার হারানোর প্রচন্ড শোককে শক্তিতে পরিনত করে পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, দীর্ঘদিনের অনিয়ম আর মিথ্যাচারের উপর ভর করে থাকা শাসন ব্যবস্থাকে সুশৃঙখল ধারায় ফেরানোর আপ্রান প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ৯৬'সালের সেই সরকারের সময়কালে অসংখ্য উল্লেখ করার মতো সফলতা অর্জিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে জাতি হিসেবে নতুন করে বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিলাম পার্বত্য শান্তি-চুক্তি, স্বাধীনতার পর প্রথম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ইন্টারনেট জগতে আমাদের পদচারণা, সাধারনের হাত পর্যন্ত মোবাইল ফোনকে সহজলভ্য করে দেয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি ইত্যাদি অসংখ্য অসংখ্য সফলতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। যা এখনো আমাদেরকে আজকের বর্তমানের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আমাদের প্রারম্ভকালীন সময়কে বেশ সুখস্মৃতি হিসেবেই স্মরণ করিয়ে দেয় । ২০০১ সালে কুটিল কুশীলবদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হলে পুনর্বার স্তম্ভিত হয়ে যায় হাসু আপার হাতে সূচনা হওয়া বাংলাদেশের উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রা। আবারও আমরা পিছিয়ে পড়ি সোনার বাংলা বিনির্মানের ধারাবাহিকতায় ।
এরপর ২০০৭ সালে অসম্ভব রকম রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়নের কারনে সৃষ্টি হওয়া কুখ্যাত এক এগারোর ভয়ংকর ষড়যন্ত্র আর অস্থিরতায় প্রিয় নেত্রীসহ বাংলাদেশ আওয়ামী পরিবারের অসংখ্য অসংখ্য জনকে তখন এক অবর্ননীয় দুর্বিষহ সময় পার করতে হয়েছে। আমাদের অনন্য সাহসী আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রিয় নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী দলের অন্তঃপ্রাণ কর্মীদের সাহসী প্রতিবাদ-নিস্বার্থ ত্যাগ-জেলজুলুমের খড়গ মোকাবিলা করেই পুনরায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল অবৈধ সেনা সমর্থিত সরকারের কবল থেকে। এই দীর্ঘসময়ে আবার পূর্বাপর অন্যান্য সরকারের ন্যায় রাষ্ট্রের সকল অগ্রযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ৯৬'র সরকারে দেশরত্ন শেখ হাসিনার কষ্ঠার্জিত অর্জনগুলো খেই হারিয়ে ফেলেছিল অস্থিরতার ঐ সময়গুলোতে।
দীর্ঘদিন ধরে গণ-আন্দোলনের মুখে অবৈধ সামরিক শাসক গোষ্ঠী নির্বাচন দিতে বাধ্য হলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারের সমর্থন নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর দ্রুত বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের চিরচেনা জরাজীর্ণ রুপ। আজকে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য-বস্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা খাতে অবিস্মরণীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে,রপ্তানি বেড়েছে সকল পন্যের,সারা দেশ জুড়েই চোখে পড়ার মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে,যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের মাইলফলক তৈরি হয়েছে। উদাহরণ বলে অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে অনেক বেশি স্বাবলম্বী। সাম্প্রতিক সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল বাজেটের প্রকল্প,মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মান, রুপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, মহাসড়কের ৪/৬ লেনের প্রশস্ত সড়ক নির্মাণের বিভিন্ন প্রকল্প সমূহ কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান-সহ অন্যান্য চলমান কিংবা প্রস্তাবিত বিশাল বিশাল বাজেটের প্রকল্পসমূহ আমাদেরকে বর্তমান বাংলাদেশের প্রকৃত সক্ষমতা সম্পর্কে সু-স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার ফলে ইতোমধ্যেই আমরা অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ভূষিত হয়েছি। সোনার বাংলার পথে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ ।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ রাতে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের ভয়ার্ত কন্ঠের করুন আকুতি যেমনটি সেদিন ঘাতকের নির্মম বুলেট থেকে শিশু রাসেলকে রক্ষা করতে পারে নি, পুরো পরিবারের সাথে তাকেও নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিল ঘাতকের বুলেট, সেই কুশলীবদের প্রচেষ্টা কিন্তু থেমে থাকেনি। মুজিব তনয়া দেশে ফেরার পর, দেশমাতৃকার কল্যানে পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে শোককে অদম্য শক্তিতে রুপান্তরিত করার শপথ গ্রহন করার পর তাকেও মুখোমুখি হতে হয়েছে অসংখ্য প্রাণঘাতী হামলার। কিন্তু তিনি ভয়ে কুঁকড়ে যান নি, তিনি সাহস হারান নি। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বারবার তিনি রক্ষা পান, বারবার ঘুড়ে দাঁড়ান। হয়ত উপর ওয়ালারই ইচ্ছা....তার হাতেই নির্মিত হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। বিশ্বাস করি বিশ্বনেতাদের আলোচনায় বারংবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটে আসীন হওয়া আমার-আপনার-সকলের আস্থার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল অদম্য আর স্বাধীনচেতা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তথা আমাদের হাসু আপার হাত ধরেই প্রিয় এই বাংলাদেশের উন্নয়ন-আধুনিকায়নের পথচলায় এক অনন্য নবযুগের প্রারম্ভ হবে, যা নজিরবিহীন ইতিহাস হিসেবেই বিশ্বদরবারে উপস্থাপিত হবে।
পরিশেষে নিচের কয়েকটি লাইন অবশ্যই বলতে চাই---
"বেঁচে থাকুক পিতা মুজিবের সোনার বাংলার স্বপ্ন,
বেঁচে থাকুক ভালোবাসা ছোট্ট শিশু রাসেলের স্মৃতিতে,
বেঁচে থাকুক অকুতোভয়-অদম্য নেত্রী শেখ হাসিনা,
বেঁচে থাকুক আমার প্রিয় বাংলার উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা।"
শেষ করার মুহূর্তে পুনর্বার বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বাঙ্গালীর ইতিহাসের রাখালরাজা,স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙ্গালির মুক্তির মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
কবির ভাষায় ---
"যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরি-যমুনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।"
"জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু"
'বাংলাদেশ চিরজীবী হোক,
জাতির পিতার স্মৃতি অমর হোক,
দেশরত্ন শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোন।।'
লেখকঃ ভূঁইয়া মোঃ ফয়েজউল্লাহ মানিক
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক- সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা)