০৫ আগস্ট ২০২১, ১১:১৬

এসএসসি-এইচএসসি মূল্যায়নে আবশ্যিক বিষয় বাদ দেয়া অযৌক্তিক

এসএসসি-এইচএসসি মূল্যায়নে আবশ্যিক বিষয় বাদ দেয়া অযৌক্তিক  © টিডিসি ফাইল ফটো

করোনা অতিমারির কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ হয়ে আছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ। অন্যসব ক্ষেত্রের মতো ধস নেমেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিক্ষাবর্ষ ভেঙে হয়েছে তছনছ। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ও পরীক্ষা গ্রহণের সময় নির্ধারণ হলেও পরিশেষে তা আলোর মুখ দেখেনি।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বর্তমান করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতি বিবেচনায় এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন বিষয়ক একটি রুপরেখা নির্ধারণ করেন। দেরিতে হলেও শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণা লাখ লাখ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীর উদ্বেগ খানিকটা হলেও কমাবে। এতোদিন তারা অনিশ্চয়তায় ছিল তাদের পরীক্ষা আদৌ হবে কি না। সে পদ্ধতি অনুযায়ী চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সব বিষয়ে না নিয়ে কেবল গ্রুপভিত্তিক নৈর্বাচনিক তিন বিষয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে পরীক্ষা নেওয়ার সময় অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রতি বিষয়ে পরীক্ষার মোট নম্বরও কমে যাবে। একই সঙ্গে প্রশ্নপত্র থেকে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন বাছাইয়ে বেশি সুযোগ পাবে। অর্থাৎ, নমনীয়তা দেখানো হবে। পরীক্ষার সম্ভাব্য সময় নির্ধারিত হয়েছে এসএসসি এ বছরের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এবং এইচএসসি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ।

নির্ধারিত এ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রশ্নের ধরন ও পরীক্ষার সময় যেমন হবে-
অর্ধেক সময়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে অর্থাৎ তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হবে দেড় ঘণ্টায়। আর প্রশ্নপত্র এখন যেভাবে বহুনির্বাচনী ও রচনামূলক/সৃজনশীল হয়, সেভাবেই হবে। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন বাছাই করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি সুযোগ পাবে। যেমন- আগে যেখানে ১০টি প্রশ্নের মধ্যে থেকে ৭টির উত্তর দিতে হতো, সেখানে এখন হয়তো সেই ১০টি প্রশ্নই থাকবে। তবে তার মধ্যে তিনটি বা চারটির উত্তর দিতে বলা হতে পারে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বিষয়ে মোট নম্বর ১০০–এর বদলে ৫০ নম্বর করা হবে। পরে এই ৫০ নম্বরকে ১০০–তে রূপান্তর করে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে যথাক্রমে ৬০ দিন এবং ৮৪ দিন শ্রেণি কার্যক্রম শেষ করে পরীক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের বর্তমান ভয়াবহতা বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে এসএসসি ও সমমানের অ্যাসাইনমেন্ট ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে ১২ সপ্তাহে মোট ২৪টি অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। তিনটি নৈর্বাচনিক বা নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ে প্রতি সপ্তাহে ২টি করে মোট ২৪টি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবে শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে মোট ৮টি করে অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে। এর মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি সম্পন্ন হবে।

এ ছাড়া এইচএসসি ও সমমানের অ্যাসাইনমেন্ট ২৬ জুলাই শুরু হয়েছে। ওই স্তরের শিক্ষার্থীদের ১৫ সপ্তাহে মোট ৩০টি অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। তাদেরও গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে মোট ছয়টি পত্রে (প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র) এই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। প্রতি পত্রে পাঁচটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। তাদেরও সপ্তাহে দুটি করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। এভাবে তাদেরও সংক্ষিপ্ত সিলেবাস সম্পন্ন হবে।

উল্লেখ্য, বাংলা, ইংরেজিসহ আবশ্যিক বিষয় এবং চতুর্থ বিষয়ে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে না শিক্ষার্থীদের। আবশ্যিক বিষয়ের নম্বর জেএসসি, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ‘বিষয় ম্যাপিং’ করে নম্বর নির্ধারণ করা হবে। অর্থাৎ, এ পদ্ধতি অনুযায়ী শুধু গ্রুপভিত্তিক নৈর্বাচনিক তিনটি বিষয়ের উপর মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হয়।

শিক্ষামন্ত্রী আবশ্যিক বিষয় বাদ দিয়ে কেবল গ্রুপভিত্তিক তিনটি বিষয়ের উপর পরীক্ষা নেওয়ার বা মূল্যায়নের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা সমীচিন নয়। কেননা, এসএসসি ও এইচএসসি উভয় শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও আইসিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা‌ বিগত বছরগুলোর পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালে দেখব, ইংরেজি ও গণিতে অকৃতকার্য হওয়ার হার অপেক্ষাকৃত বেশি। এ ছাড়া এ দুটি বিষয়ে ভালো করতে না পারলে উচ্চতর শিক্ষা তথা উচ্চ শিক্ষার সিঁড়িতে পা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এ দুটি বিষয় জেএসসি ও এসএসসির (এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য) ফলের ভিত্তিতে ম্যাপিং করা সমীচিন হবে না।

মূল্যায়নের জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও আইসিটিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া কোনভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ইংরেজিতে দুর্বল। প্রথম শ্রেনী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি বিষয় আবশ্যিক হিসেবে আমাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এবং দীর্ঘ ১২ বছর ইংরেজি বিষয়ে পড়ানো হলেও আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ইংরেজিতে দুর্বল- ইংরেজিতে তারা ঠিকভাবে দুটো লাইন বলতে লিখতে পারে না। দীর্ঘ ১২ বছর ইংরেজির উপর পড়ানো হলেও শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে পারদর্শী না হয়ে ওঠার পেছনে পাঠদানের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ও বিষয়। ইংরেজি পৃথিবীর সব দেশের দ্বিতীয় স্বীকৃত ভাষা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব কার্যক্রমে ইংরেজি অপরিহার্য একটি বিষয়। ইংরেজির অপরিহার্যতা কি সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি। তাছাড়া ইংরেজি বিষয়ে পারদর্শিতা ছাড়া উচ্চ শিক্ষার সিঁড়িতে পা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, সরকারি-বেসরকারি সব ধরণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে ইংরেজি বিষয়ে ভালো করার কোনো বিকল্প নেই।

গণিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রতিটা মানুষেরই গণিতের উপর জ্ঞান থাকতে হয়। উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রে গণিতের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়।

বৈশ্বিকভাবে বর্তমানে আইসিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমান বিশ্বে আইসিটি খাতে যে দেশ যত বেশি সমৃদ্ধ, সে দেশ তত বেশি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। ডিজিটাল বিশ্বের সবকিছুই আইসিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বলা চলে, বিশ্ব জুড়ে আইসিটির এখন দোদন্ড প্রতাপ। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা আইসিটিতে কি পরিমাণ দুর্বল, কি পরিমাণ পিছিয়ে তার নজির লক্ষ্য করা গিয়েছে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে। আমাদের দেশের মানুষ আইসিটিতে অনেক পিছিয়ে। তাই আইসিটির মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মূল্যায়নের তালিকা থেকে বাদ দেয়া কোনভাবেই যৌক্তিক নয়।

মূল্যায়নের বিষয় থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কেননা, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের রাষ্ট্রভাষা। যে ভাষায় জন্য আমরা বাঙালি হিসেবে বিশ্বের বুকে একমাত্র জাতি হিসেবে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছি, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছি; যে ভাষা আমাদের রক্ত দিয়ে কেনা সে ভাষা-বিষয় মূল্যায়নের তালিকায় না থাকা ভীষণ দুঃখজনক ব্যাপার। তাছাড়া বিশ্ব দরবারে আমাদের বাংলা ভাষার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হলেও বেশিরভাগ মানুষ প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন না। যেখানে আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে কাজ করার কথা সেখানে মূল্যায়নের তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

প্রায় দেড় বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দেশে এখন করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে। যখন করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল, সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ছিল তখন বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বারবার তারিখ ঘোষণা করেও পরিশেষে কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলো না- সে প্রশ্ন না উঠে পারে না। সম্প্রতি ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ও ইউনেসকোর মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুল যৌথ বিবৃতিতে লাখ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার তাগাদা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সংক্রমণ শূন্যে চলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। এ বিবৃতি সব সদস্যদেশের জন্য হলেও বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কেননা, যে ১৯টি দেশে করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।

স্কুল, কলেজ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও দীর্ঘসময় ধরে গৃহবন্দি থেকে একধরনের হতাশা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফল আটকে আছে, এর ফলে চাকরিবাকরির জন্য
কোথাও আবেদন করতে পারছে না, অনেকের আবার চাকরির নির্ধারিত বয়স শেষ হওয়ার পথে। এসব বিষয় নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের তালিকা থেকে আবশ্যিক বিষয়সমূহ বাদ দেয়া কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে সেটা ভালো- এতে তারা পড়াশোনা ও একধরনের চর্চার মধ্যে থাকবেন। কিন্তু মূল্যায়নের তালিকা থেকে আবশ্যিক বিষয় বাদ দেয়া কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আশা করি, নীতিনির্ধাররা এ বিষয়ে পুনরায় ভাববেন।

লেখক: শিক্ষার্থী: ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়