সেশনজট নিরসনে প্রয়োজন প্রযুক্তির ব্যবহার
চলমান করোনা মহামারীর কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। মাঝে কিছুদিনের জন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে পরীক্ষা নিলেও মহামারীর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ক্যারিয়ার ভয়ানক হুমকির মুখে পড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে সেশনজটের সময়কাল। এতে করে শিক্ষার্থীরা চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার মতো পথ। এই ভয়াল অন্ধকার থেকে মুক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। জুলাই থেকে অনলাইন মাধ্যমে ক্লাস শুরু করা হয়। গত বছরের শেষে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ২ মাস পরীক্ষা চলমান রেখে আবারও বন্ধ করে দিতে হয়। আবার এ বছরের জুনে ১০-১৫ দিনের জন্য পরীক্ষা চালু রাখতে সক্ষম হয়। ঢাবি, জাবি, শাবিপ্রবি, নোবিপ্রবিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন মাধ্যমে পরীক্ষা নিচ্ছে। বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বসে আছে কবে ভ্যাকসিন প্রদান শেষ হবে, কবে আবার সশরীরে পরীক্ষা শুরু করতে পারবে এমন সময়ের জন্য। এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে দীর্ঘকাল একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। যেখানে বিশ্বের প্রায় সবাই অনলাইন বা অফলাইন যেকোনভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে সেখানে আমরা বসে আছি কেন? গত এক দশকে আমরা প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়েছি এটা ধ্রুব সত্য। তাহলে এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন কোন ব্যাবস্থা নিচ্ছেন না?
যেকোন কিছুই নতুন হলে আমাদের শিখতে হয়। সামনে এগিয়ে যেতে সমস্যা আইডেন্টিফাই করে সমাধান করতে হয়। অনলাইন পরীক্ষা আমাদের দেশের জন্য নতুন। আমরা অভ্যস্ত নই। পারবো না বা কঠিন বলে বসে থাকার কোন অর্থ হয় না। নতুন হওয়ায় অনলাইনে পরীক্ষা কার্যক্রম চলাতে গেলে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে এটাকে উপেক্ষা করা বোকামি। সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। সমস্যা থাকে বলেইতো আমরা সমাধান করতে পারি। এর মাধ্যমে পুরো প্রজন্মকে অনলাইনে কিছুটা হলেও দক্ষ করে তোলা সম্ভব।
এবার আসি সমস্যার কথায়। অনলাইন পরীক্ষায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও একটা অংশের আগ্রহ নেই। একজন শিক্ষার্থীও যদি অনলাইন পরীক্ষায় অনাগ্রহী থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়। তাহলে কেন একটি অংশের আগ্রহ নেই? এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, নেটওয়ার্ক সমস্যা। এখন দেখুন, আমরা যদি সশরীরে পরীক্ষা দিতে চাই তাহলে কিন্তু একটা পথ পাড়ি দিয়ে পরীক্ষা দিতে আসতে হয়। তাহলে অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে নিজের বাড়িতে নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকলে কিছু দ‚রে যে স্থানে ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় সেখানে কিছু সময়ের জন্য গিয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অনিশ্চয়তায় বসে থাকার চেয়ে এতটুকু ত্যাগ করাই যায়।
দ্বিতীয় যে কারণ তা হলো, ডিভাইস ও অধিকম‚ল্যের ডাটাপ্যাকের সমস্যা। ডিভাইসের জন্য ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কিছু পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন অপারেটরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্বল্পম‚ল্যের ডাটা প্যাকের ব্যাবস্থা করেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তা অনুসরণ করতে পারে। প্রয়োজনে আবারও শিক্ষার্থীদের ঋণ দেয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ থাকায় পরিবহন খাত, আবাসন খাতসহ কয়েকটিখাতে একটি উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ থেকে যাচ্ছে। এগুলো শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ব্যয় করা যায়। আর্থিক সমস্যায় থাকা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঋণ হিসেবে এ খাতগুলোর টাকা ব্যয় করতে হবে। আর অন্য যে সমস্যাগুলো তা এতোটা প্রকট নয়। অনলাইনে পরীক্ষা নিলে অবশ্যই শতভাগ শিক্ষার্থীর সম্মতি থাকতে হবে। প্রয়োজনে যে বিভাগ/ব্যাচের শিক্ষার্থীরা শতভাগ সম্মতি দিবে তাদের পরীক্ষাগুলো নিয়ে নেয়া উচিৎ। আবার যারা অনাগ্রহী তারা কেন অনাগ্রহী সে কারণ উদঘাটন করে তার সমাধান করা যেতে পারে।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চরমভাবে হতাশায় ভুগছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো ভয়ানক পথ বেছে নিচ্ছেন। এটা আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর হুমকি। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের মে পর্যন্ত মোট ১৫ মাসে অন্তত ৪০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তারমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ১২ জন। ভাবতেও গা শিউরে উঠে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের এভাবে চলে যাওয়াটা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।
সবশেষ, এমন অনিশ্চয়তায় আর বসে থাকার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষার্থীদেরকে সহযোগীতা করতে হবে। আবার শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তার সমাধান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে করতে হবে। একে অপরের সাথে সমন্বয় করতে হবে। তবেই এর সুফল আসবে। আবার শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার সাথে সাথে ক্যাম্পাসগুলো খুলে দিতে হবে। আমাদের অনেক কিছুরই সামর্থ্য নেই। কিন্তু যতটুকু আছে তার সর্বোচ্চ ব্যাবহার করতে পারছি কিনা, এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে হবে। সর্বোপরি, একটি যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দেশের শিক্ষার্থীসমাজকে এ ভয়ানক অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে হবে।