যেমন কাটলো বেসরকারি শিক্ষকদের কুরবানির ঈদ
বছর ঘুরে বরাবরের মতই এবারও এসেছিলো মুসলিম জাতির অন্যতম প্রধান উৎসব কুরবানির ঈদ। এটি করোনাকালের চতুর্থ ঈদ। আমাদের দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে এ ঈদ উদযাপন আর্থিক স্বচ্ছলতা ভেদে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় এ ঈদের আনন্দ অনেক তারতম্যপূর্ণ ও বিষাদময়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তিন ধরনের শিক্ষক রয়েছে; সরকারি, আধাসরকারী ও বেসরকারি। সুবিধা ভোগের দিক থেকে সরকারি শিক্ষকদের জীবন যাপন প্রণালী বেশ স্বাচ্ছন্দময় হলেও অন্যান্য দুই ক্যাটাগরি তথা আধা সরকারি বা এম পি ও অধিভুক্ত এবং সম্পূর্ণ বেসরকারী শিক্ষকদের বেলায় সেটি বিষাদময় ও অস্বাচ্ছন্দকর। কারণ, অর্থের স্বচ্ছলতা যেখানে স্বাদ-আহলাদ ও আনন্দ-বিনোদনের প্রধান শক্তি, সেখানে যাদের অর্থ নেই বা যে সকল চাকুরীজীবি বোনাস পান না বা পেলেও খুবই সীমিত, তাদের ঈদ যে খুব আরামে কাটে না তা সহজেই অনুমেয়।
বেসরকারি শিক্ষক বলতে আমি বুঝিয়েছি, তাদেরকে যারা আধা-সরকারি বা এমপিও অধিভুক্ত শিক্ষক বা সম্পূর্ণ বেসরকারি শিক্ষক, যারা ব্যক্তি মালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা বিচারে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনবল অনেক বেশি যা মোট জনবলের প্রায় ৮৭ শতাংশ। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায় যে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫৫ হাজারেরও বেশি বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় পৌনে ১০ হাজার এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৫টি এবং মেডিকেল, ডেন্টাল, কওমি মাদ্রাসাতো আছেই আরো হাজারে হাজার।
এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোয় রয়েছে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী, কারিগরি প্রতিষ্ঠানে জনবল আছে প্রায় আড়াই লাখ। বেসরকারি ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আছে আরও অন্তত ৯০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। আর ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ৩২ হাজার। এছাড়াও বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত ৪ শতাধিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজারেরও বেশি। সবমিলে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। অন্যদিকে যদি দেশের ভিন্ন ধারার আরেকটি শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ধরি তা হলো কওমি মাদ্রাসা, যেখানে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল, প্যারামেডিক্যাল ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ যুক্ত করলে এদের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রায় ১৬ মাসের অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সরকারি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী শতভাগ বেতন-বোনাস পেয়ে থাকলেও এমপিও ভুক্ত চাকুরেরা পেয়ে থাকেন মূল বেতনের মাত্র ২৫%। আর বেসরকারি শিক্ষকদের কথাতো বাদই দিলাম। তাদের অনেকে ফুল বা রেশনিং হারে বেতন পেয়ে থাকলেও কর্তৃপক্ষের মর্জি হলে তারা বোনাস পান বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পান না। এবারের ঈদেও তাই হয়েছে। কি বৈষম্য! কী ব্যবধান!! অথচ দেশের শিক্ষার মূল ধারার বাইরেও বেসরকারি শিক্ষকগণ শিক্ষার সম্প্রসারণে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে থাকেন। তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, বেশ কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বোনাস ঠিকমত দিয়েছেন, তবে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫% এর বেশি নয়।
অতএব, ঈদে বেতন বোনাস প্রাপ্তির অবস্থা যদি এমন শোচনীয় হয়, তাহলে কেমন কাটতে পারে বেসরকারি শিক্ষকদের ঈদ তো বলাই বাহুল্য। দীর্ঘ লকডাউনের ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঠিকমত বেতন-বোনাস না পাওয়ায় অনেক শিক্ষক চাকুরি ছেড়ে এবং চাকুরিচ্যুত হয়ে শাক-সবজি বিক্রি করছেন, কৃষি কাজ করছেন, কেউ কেউ আবার ভ্যান-রিক্সাও চালাচ্ছেন বলে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিবেদনে খবর প্রকাশিত হয়েছে। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের শিক্ষকদের এহেন করুণ পরিস্থিতিতে আমারা আসলেই লজ্জা পাই। ঈদের আনন্দ একে অন্যের সাথে শেয়ার করে নেয়ার মাঝেই পাওয়া যায় প্রকৃত পরিতৃপ্তি। একজন এমপিও শিক্ষক যদি ২৫% বোনাস পান, তাহলে স্কুল কলেজের বেতন স্কেল অনুযায়ী তারা স্তর ভেদে বোনাস পেয়ে থাকেন সর্বোচ্চ ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা, যা দিয়ে ফ্যামিলির সকল সদস্যের প্রয়োজনীয় চাহিদাই মেটানো যায় না, তাহলে কুরবানি দেয়ার আশাতো গুড়ে বালি। অন্যদিকে যারা আংশিক বেতন পান বা বোনাস না পান, তাদের প্রসংগে বলা এখন অর্থহীন।
আমরা জানি, শিক্ষক শ্রেণি সমাজের মান্যগণ্য ও সম্মানীয় ব্যক্তি। তাদের চক্ষু লজ্জা অনেক বেশি। তারা পেটের ক্ষুধা চেপে রেখে শিক্ষাদান অব্যাহত রাখেন। তারা অভাব অনটনে কারোর কাছে হাত পাততে পারেন না এবং বলতেও পারেন না। এভাবে চাপা কষ্ট বুকে ধারণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করে থাকেন, কিন্তু সম্মানের হানি হবে বা লোকে কি বলবে - এ চিন্তায় তারা নিরব বেদনা বিধুর জীবন অতিবাহিত করেন। এ যেন তাদের বোবাকান্না। সীমাহীন দুর্ভোগের করোনাকালীন এ সময়ে এবারের ঈদও তাদের কেটে গেলো হর্ষ-বিষাদে ভরা এক অস্থিরতম অবস্থার মধ্য দিয়ে। শিক্ষকদের ঘরে ঘরে আজ বোবাকান্নার নিরব আর্তনাদ, যা তাদের পরিবারকে দিন দিন হতাশাগ্রস্থ করে তুলছে।
এমতাবস্থায়, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতি সুদৃষ্টি দেয়া অত্যাবশ্যক। অন্যথায়, দেশ ও জাতি করোনা পরবর্তিতে এক মহাসংকটে উপনিত হবে। ফলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া যাবে না এবং শিক্ষকরা শিক্ষা পেশায় আর আগ্রহও দেখাবে না। বলতে দ্বিধা নেই যে, আজ যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন বা যারা চাকরি-বাকরিতে যুক্ত আছেন, তাদের সকলই কোন না কোন শিক্ষকের অবদানেই আজ এ অবস্থানে এসেছেন। সুতরাং আসুন, শিক্ষকদের বোবাকান্না দূর করতে তাদের পাশে দাঁড়াই এবং জাতি বিনির্মানের ব্রত নিয়ে তাদের কল্যাণে আমারা ইতিবাচক চিন্তা চেতনা পোষণ করি।
লেখক: প্রবন্ধিক, শিক্ষা গবেষক ও প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা