ইদ নাকি ঈদ?
অনেকে বলে থাকেন, যাদের বয়স তিরিশের বেশি— ‘ইদ’ লেখায় তাদের আনন্দ নেই। একথাটি কিন্তু আপনি তিরিশের কম বয়স, এমন ছেলে বা মেয়ের মুখে খুব একটা শুনবেন না। এর কারণ, ‘ইদ’ বানানটি একালের ছেলেমেয়েরা তাদের টেক্সট বুকে (আমি ইচ্ছে করেই ‘পাঠ্যপুস্তক’ কথাটি ব্যবহার করলাম না) আগে থেকেই পেয়েছে। তাই ‘ইদ’ শব্দটি নিতে তাদের আপত্তি নেই এবং ইদে তাদের আনন্দও কম নয়। আপত্তি করছেন এবং সব জেনেও জোর করে তাদের বানানই প্রয়োগ করছেন বড়োরা। (বড়োদের গায়ের জোরতো বেশিই, তাই না?) অন্য বানান নিয়ে কিন্তু তেমন ‘রা’ ওঠেনি। ‘গরীব‘ বানান ‘গরিব‘ হয়েছে, ‘শ্রেণী‘ বানান ‘শ্রেণি’ হয়েছে, ‘ঈগল’ বানান ‘ইগল’ হয়েছে— কোনো আপত্তি নেই। বড়োরা, অনেকেই, ‘ঈদ’ বানানটির পরিবর্তন নিতে পারছেন না, এর প্রধান কারণ শব্দটির লিখিত image তাদের চোখে আটকে আছে। আর এর সঙ্গে তারা নিজেদের অজান্তেই ধর্মীয় আবেগকেও খানিকটা যুক্ত করেছেন বটে। ছোটোবেলা থেকে তারা ‘ঈদ’ বানানটি দেখে আসছেন, লিখেও আসছিলেন। তাই ‘ঈদ’ বানান ‘ইদ’ হলে চোখেতো ঠেকেই!
আমার মনে আছে, অধ্যাপক মনসুর মুসা তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তাঁর বসবার কক্ষ এখন প্রেস যেখানে, তার দোতলায়। তরুণ আমি বানান নিয়ে কাজ করি। বানান নিয়ে এক সেমিনারে তিনি আমাকে ডাকলেন। তরুণ ছিলেন হাকিম আরিফও। তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগবৈকল্য বিভাগের প্রবর অধ্যাপক। তিনিও গেলেন। আবার আজকের ইউজিসি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জামিল চৌধুরী, বশীর আলহেলাল প্রমুখও ছিলেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীতো ‘বাঙালি’ বানান কোনোভাবেই মানবেন না। বলেই ফেললেন : যে বানান লিখে ‘বাঙালী’ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই বানানকে ‘বাঙালি’ করা যাবে না। মনসুর মুসার আর এক বয়ান : ‘স্পীকার’ বানান বাংলাদেশের সংবিধানে আছে বলে সেটাও ‘স্পিকার’ লেখা যাবে না। ড. হাকিম আরিফ, আমার এই পোস্টটি আপনি পড়লে নিশ্চয়ই মনে পড়বে, সেদিন আপনি ও আমি কীভাবে ‘বাঙালি’ ও ‘স্পিকার’-এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে সমস্বরে বক্তব্য দিয়েছিলাম। এরপর নানাসময় বাংলা একাডেমি কী কী ভাবে যেন বানান পাল্টায় ! গত বছর এই দিনগুলোতে তো ‘গরু‘ আর ‘গোরু‘ নিয়ে লড়াই বেঁধেছিল। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় লেখা হলো : যেটি মোটাতাজা তার বানান হবে ‘গোরু’ আর যেটি মোটা নয় সেটির বানান ‘গরু’! হাসি নয়, সত্যি বলছি।
বানানে এভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা, সংবিধানের দোহাই, ধর্মের আবেগ ইত্যাদি বিভিন্নজন নানাসময় দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলা বানান যে নিয়মের একটি কাঠামো পেয়েছে এবং পরিশীলিত হয়েছে, পৃথিবীর অন্য ভাষায় এর দৃষ্টান্ত বিরল। বানানের বেলায় আমরা কেন নিয়মের কাছে আবেগকে মুখ্য করবো? কিন্তু সেটাই করেছি। অধ্যাপক মনসুর মুসা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন দু-দুবার। কিন্তু তিনি নিজেই বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম মানেননি। মহাপরিচালক পদে থেকেও তিনি এটি করেছেন! প্রতিষ্ঠান-প্রধান হয়ে মানেননি প্রতিষ্ঠান-প্রবর্তিত বানানরীতি। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ‘ঈদ’ আর ‘ইদ’ নিয়ে সাধারণ মানুষতো দ্বিধায় থাকবেই। হয়েওছে তাই। কিন্তু আমার মনে হয়, বাংলা একাডেমির বানানরীতি অনুসরণ করাই বাংলা বানান শুদ্ধতার নিরাপদ আশ্রয়।
এবার আসি ‘ঈদ’ আর ‘ইদ’ নিয়ে। আরবি ভাষার শব্দ ‘ইদ’ (আমি ‘ইদ’ লিখছি)। আরবি ভাষার ধ্বনি-প্রলম্বনের জন্যই এটিকে বলা হতো : ই্ইদ, লেখা হতো ঈদ। যেমন, এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের নাম ‘আরবী বিভাগ’। তারা উচ্চারণ করেন : আ(রঅ)বী, আর্ বি নয়। সে হিসেবেই ঈদ বানানটি চলে এসেছে অনেক আগে থেকে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা থেকে উদ্ধার করা যাক : ‘ঈদজ্জোহার তকবির শোন ঈদগাহে।’ তখন বানানটি এভাবেই লেখা হতো। বাংলা ভাষায় আগত শব্দগুলোকে প্রথম দিকে নানা বানানেই গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, প্রথম দিকে Shakespeare-কে অনেকে বাংলায় লিখেছিলেন ‘শেক্ষপীয়র’ বলে। Max Müller-কে লেখা হয়েছিল ‘মোক্ষমূলার’। সেই বানান আজ পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে বানানের ইতিবাচক পরিবর্তন বা বিবর্তন ভাষার অগ্রগতিরই লক্ষণ। ‘ঈদ’ বানান যে ‘ইদ’ হলো সেটিকে অগ্রগতি হিসেবেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানবিধি (১৯৯৪) স্পষ্ট করে ২.০১ ধারায় বলেছিল : ‘সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের –কার চিহ্ন ব্যবহৃত হবে।’ কিন্তু তারাই আবার অভিধানে (দেখুন, জামিল চৌধুরী সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলা বানান-অভিধান’, জুন ১৯৯৪) ‘ঈদ’ বানান রেখেছিল, সেখানে ‘ইদ’ শব্দটি ছিলই না। আরবি শব্দ হওয়া সত্ত্বেও কেন এমনটি করা হলো তা বাংলা একাডেমিই ভালো বলতে পারবে। একাডেমির বানানবিধিটির সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ ইত্যাদির মার্চ ২০১৮-র একটি কপি আমাদের হাতে আছে। সেখানে ধারাটি হয়েছে ২.১ এবং এর কথাগুলো আগের মতোই অর্থাৎ অপরিবর্তিত । এবার বাংলা একাডেমির জামিল চৌধুরী সম্পাদিত (লক্ষ করুন : আগেরটি ছিল ‘সংকলিত ও সম্পাদিত’) ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬) স্পষ্ট করে দিয়েছে : ‘ইদ’ হলো ‘সংগততর’ বানান এবং ‘ঈদ’ ‘অসংগত’ বানান। বাংলা একাডেমি যা করে, এখানেও তাই! তারা মুক্ত আলোচনায় যায় না (নাকি ভয় পায়?), তাই ফাঁক থাকে। আর এই ফাঁকে পড়ে বাংলা বানানের ভুল-শুদ্ধ দ্বন্দ্বে নিপতিত হয় হাজার হাজার বাংলাপ্রেমী। এখন, এখানে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, ‘ইদ’ ‘সংগততর’ আর ‘ঈদ’ ‘অসংগত’ বানান— তাহলে ‘সংগত’ বানান কোনটি ভাই? আমিতো ‘সংগত’ বানানটি খুঁজছি, ‘সংগততর’ দরকার নেই, আর ‘অসংগত’তে যাবই না!!
যা হোক, বাংলা একাডেমির এ অবস্থার মধ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শুধু আস্থা রাখি, ভবিষ্যতে আরও শাণিত হোক এই প্রতিষ্ঠান। অতএব, যেহেতু প্রমিত নিয়মে বলা হয়েছে : ‘সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের –কার চিহ্ন ব্যবহৃত হবে।’; যেহেতু ‘ইদ’ আরবি শব্দ অর্থাৎ বিদেশি, সেহেতু বানানটি ‘ঈদ’ নয়, হবে ‘ইদ’। সেভাবেই ইদগাহ, ইদি, ইদ মোবারক!
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত