এখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবি জোড়ালো হওয়া স্বাভাবিক

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে বেশকিছুদিন আন্দোলন হয়েছে। এসব আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে অধ্যাপক আখতার
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে বেশকিছুদিন আন্দোলন হয়েছে। এসব আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে অধ্যাপক আখতার  © ফাইল ছবি

অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ কিছু কথা বলতে চাই। কাউকে দোষ দেয়ার জন্যে নয়, কাউকে কটাক্ষ করার জন্যও নয়, কেবলই মনের কষ্টটা প্রকাশ করে কিছুটা হলেও হালকা হওয়ার চেষ্টা।

গতবছর করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আসলে শুরু হয়েছিল মনোবেদনা। দুঃখ করে তাই লিখেছিলাম মাছ যেমন পানি ছাড়া বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না তেমনি ক্লাস, পরীক্ষা, শিক্ষার্থীদের সরগরম করা ক্যাম্পাস ছাড়া শিক্ষকরা থাকেন মৃতপ্রায়।

তবুও কিছুটা রক্ষা অনলাইনে ক্লাস চলছে। তবে শিক্ষার্থীদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। আমাদের মতো দেশে ভার্চুয়াল ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকাটাও বেশ কষ্টসাধ্য। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীদের টিউশনি করে নিজের, এমনকি পরিবারের খরচও চালাতে হয়। তাদের কষ্টটা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি জোড়ালো হওয়াটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হলেও শিক্ষক হিসাবে এই দাবির সাথে আমরাও একমত। আমার বিশ্বাস প্রায় সব শিক্ষকই মনে প্রাণে চান ক্লাসরুমে ফিরে যেতে।

তবে প্রশাসনিক পদে কর্মরত শিক্ষকগণের বিষয়টা অন্যরকম। তাঁদের অনেক কিছুই চিন্তা করতে হয়, অনেক জায়গায় তাঁদের সীমাবদ্ধতা থাকে, ইচ্ছে করলেই সব সিদ্ধান্ত তাঁরা নিতে পারেন না। তবে বেশিরভাগ শিক্ষকইতো শিক্ষার্থীদের সাথে সহমত পোষণ করে দাবি জানাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার।

ড. মো. আখতার হোসেন খান

এবার বলি আরো দুঃখের কথা। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে শিক্ষার্থীরা ঢালাওভাবে সব শিক্ষককেই দায়ি করছেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ব্যাপারে। মাঝে মাঝেই খোঁটা শুনতে হচ্ছে আমাদের বেতন, আবাসন, ইত্যাদি নিয়েও। তখন কষ্টটা আরো বেড়ে যায়, ‘ভাতের খোঁটা’ সবচেয়ে বড় খোঁটা।

পড়ুন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে

অনলাইনে ক্লাস নিয়ে সেশনজট এড়াতে আমাদের প্রচেষ্টার কোন কমতি নেই। বিশেষভাবে সবারই বুঝা উচিত বিশ্ববিদ্যালয় খোলা বা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষকেরই জড়িত থাকার সূযোগ বা ক্ষমতা নেই। তাই ঢালাওভাবে তাদের সবাইকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য সত্যিই দুঃখজনক।

ব্যক্তিগতভাবে আমার ছাত্র ছাত্রীরা বলতে পারবেন, আমি কতোটা আবেগপ্রবণ তাদের ব্যাপারে। কোন সমস্যা নিয়ে আমার কাছে এসেছে কিন্তু আমি তা সমাধানের চেষ্টা করিনি এমন কোন ঘটনা আমারতো মনে পরে না, যখন আমি একটি হলের প্রভোস্ট ছিলাম তখনও এবং এখনও।

শিক্ষকতা আমার কাছে পেশা নয়, ভালবাসা। তা না হলে প্রায় ৮ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য ছুটে আসতাম না। অনেকেই এখানে জয়েন্ট করার পরে উচ্চতর ডিগ্রি করার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেন না। কিন্তু দেশে কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা না থাকা সত্ত্বেও আমি চলে এসেছিলাম শুধুমাত্র মনের আকুলতায়। আজ ‘বেতন আবাসনের’ খোঁটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা আসতে পারে ‘তবে কি দেশে এসে ভুল করেছিলাম!’

আশাকরি প্রিয় শিক্ষার্থীরা ভুল বুঝবেন না। বরাবরের মতোই তাদের সব ধরনের যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার সাথে সহমত পোষণ করি। তবে অনুরোধ শুধু এটুকুই যে, ঢালাওভাবে এমন কোন মন্তব্য যেন না করা হয় যা অন্যদের কষ্ট দেয়। কদিন পরে আজকের শিক্ষার্থীরাইতো আসবেন আমাদের জায়গায়, তখন তারা বুঝতে পারবেন আমরা কতোটা মনোকষ্টে কালাতিপাত করি। ছাত্র ছাত্রীদের সমস্যাগুলো যখন সমাধান করতে পারি না তখন কষ্টগুলো আরও বেড়ে যায়।

যাক, দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন প্রিয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সবাইকে হেফাজতে রাখেন, সুস্থ রাখেন। এই মহামারী থেকে সবাইকে যেন রক্ষা করেন, খুব তাড়াতাড়ি যেন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় প্রাণ ফিরে পায় আমাদের সবার প্রিয় এই ক্যাম্পাস।

লেখক: অধ্যাপক, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ