শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে
প্রায় দেড় বছর হতে চলল আমরা করোনাকে পর্যবেক্ষণ করেছি। করোনার গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করেছি। প্রথমদিকে করোনার ভয় আমাদেরকে যতটা আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছিল; বর্তমানে আমরা ততটা আতঙ্কগ্রস্থ নই। প্রথমদিকে দেখা গেছে মাকে ফেলে সন্তান পালিয়ে গেছে কিংবা আপনজনকে ফেলে আপনজনকে পালিয়ে গেছে, এখন এমনটা হচ্ছে না।
আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি-
১. শুধু করোনা কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না। যদি না তার অন্য কোন রোগ থাকে।
২. বিশ বছর বয়সের কম বাচ্চাদের করোনা আক্রান্তের হার খুবই কম এবং মৃত্যুর হার শূন্যের শূন্যের কোঠায়।
৩. টেস্ট করলে অনেকের মধ্যে এ জীবনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে কোন উপসর্গ থাকে না। রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষী একজন সৈনিকের আঠারো মাসে ১৮ বার করোনার টেস্ট করানো হয়েছে। এরমধ্যে ছয়বার পজেটিভ এসেছে। তার কোনো উপসর্গ নেই।
৪. এ জীবানুটি যে ছোঁয়াচে সেটা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো করোনা তাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
৫. করোনা সহজে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
৬. করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলেই করোনা হবে এমনটা নয়। ঘরে বসে থাকলেও করোনা হতে পারে। কারণ ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ানো একটি জীবাণু।
৭. দুইবার টিকা নেওয়ার পরেও আবার আক্রান্ত হয়েছে। এমন খবর আমরা পত্র-পত্রিকায় পেয়েছি।
৮. করোনা প্রতিরোধে লকডাউন কোন বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নয়। এর ক্রিয়ার চেয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। লকডাউনের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।
এমতাবস্থায় আমাদেরকে একটু নাড়াচাড়া দিয়ে বসতে হবে। করোনা নামক অতিক্ষুদ্র জীবাণুর ভয়ে আমরা আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে যদি ঘরে বসে থাকি তাহলে প্রকৃতি আমাদেরকে বিদ্রুপ করে বলবে, ‘‘তোমরা নাকি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, তাহলে ঘরে বসে আছো কেন?’’
এমনিতেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শিক্ষার মানে আমরা পিছিয়ে আছি। তারপর যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা একটানা বন্ধ করে দেই তাহলে আমাদের মান আরও পেছনে চলে যাবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের শিক্ষার্থীরা অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবিরত বন্ধ পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে।
ইউনিসেফ-ইউনেস্কো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে বলেছে। এভাবে বন্ধ রেখে যে উপকার হবে ক্ষতি তার চেয়ে বেশি হবে। যদিও সে ক্ষতির পরিমাপ করা কঠিন। জাতি মেধাশূন্য হয়ে যাবে।
তিনটি সম্ভাবনা মাথায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা করা উচিত ছিল। সম্ভাবনা তিনটি হলো-
১. করোনা পৃথিবী থেকে আর যাবে না এবং ক্রমশই বৃদ্ধি পাবে। এমতাবস্থায় আমাদের কর্মপরিকল্পনা কি হবে?
২. করোনা স্থিতি অবস্থায় থাকলে কর্মপরিকল্পনা কেমন হবে?
৩. করোনা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী গ্রুপ ভিত্তিক তিন বিষয়ের পরীক্ষা হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তা তিনি আরো ছয় মাস আগে দিতে পারতেন ।তাহলে জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হতো না। আমি মনে করি এই প্রক্রিয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিভাজন করে, কেন্দ্র সংখ্যা বাড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এখনো পরীক্ষা নেওয়া যায়। তাহলে পরীক্ষা জট হতো না, সেশনজট হতো না। অনলাইন ক্লাস গুরুত্ব পেত।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, সংক্ষিপ্ত সময়ে, নমনীয় প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া এখন আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই বন্ধের প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক অব্যাহত থাকলে শিক্ষার মানে ধস নেমে আসচে। সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো না।
মহামারী করোনাকে চলমান ধরে নিয়ে আমাদের এখনই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। যাতে পরবর্তী সেশনের শিক্ষার্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। আমরা যেন মেরুদন্ড ভেঙে ফেলে মাজা ব্যথার চিকিৎসা না করি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় অনেক পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন
১. সন্তানের সাথে অভিভাবকের দূরত্ব বাড়ছে।
২. শিক্ষার্থীদের শরীর-মন অলস হয়ে পড়ছে।
৩. শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে।
৪. শিক্ষার্থী ও অভিভাবক হতাশা ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
৫. বিভিন্ন রকম নেশাজাতীয় গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
৬. কেউ কেউ ভয়াবহ মাদকের ছোবলে পড়ছে।
৭. বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে।
৮. শিশু শ্রম ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে।
৯. শিক্ষার্থীদের মন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।
১০. শিক্ষা বিরতির কারণে মেধা জং ধরে যাচ্ছে।
১১. অভিভাবকদের আর্থিক সংকট প্রকট হচ্ছে।
১২. প্রযুক্তিতে আসক্তি বাড়ছে।
১৩. আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছেে।
শিক্ষকরাও নানা বিধ সমস্যায় ভুগছেন। এমপিওহীন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আর্থিক কষ্টে মানবতার জীবনযাপন করছেন। বয়স্ক শিক্ষকরা নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি থাকার কারণে অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, স্থূলতা, ওজন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন।
আল্লাহতালা প্রকৃতিতে সবকিছু সৃষ্টিতে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। মানুষ যদি সেই ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় তাহলে মানুষই বিপদে পড়ে।
এক রাজা তার একমাত্র রাজ কন্যাকে নিয়ে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন হরিণ শিকার করার জন্য। হঠাৎ একটি বাঘ এসে রাজ কন্যাকে ধরে নিয়ে যায়। হতবিহ্বল রাজা রাজ প্রাসাদে ফিরে আসেন এবং নির্দেশ দেন সমস্ত বাঘ হত্যা করার জন্য। সৈন্যসামন্ত বাঘ হত্যার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
এক মন্ত্রী রাজাকে পরামর্শ দেন বাঘ নিধনের জন্য বাঘ মারার দরকার নেই। বনের সমস্ত হরিণ মেরে ফেললে বাঘ না খেয়েই একাই মরে যাবে। মন্ত্রীর কথা মত রাজা তখন হরিণ মারার নির্দেশ দেন।
রাজ্যজুড়ে হরিণের মাংস খাওয়ার উৎসব পড়ে যায়। বাঘ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য হরিণ না পেয়ে লোকালয় হানা দেয়, মানুষ গরু ছাগল ধরে নিয়ে যায়। এবার রাজা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। হরিণ মারা বন্ধ করলেন। উন্নত অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনী পাঠালেন বাঘ মারার জন্য। সেনাবাহিনী বনের বাঘ প্রায় শেষ করে ফেলল।
তখন হরিণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেল। বনে হরিণের তখন অভয়ারণ্য হয়ে গেল। হরিণ বনের গাছপালা লতাপাতা খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। বন উজাড় হয়ে গেল। এর ফলে সাগরের জলোচ্ছ্বাস এসে স্থলভাগে আঘাত করলো, মানুষের গাছপালা ফসলাদি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রাজার তখন উপলব্ধি হলো প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রক্ষার জন্য বাঘ, হরিণ, গাছপালা সবই প্রয়োজন আছে।
আমরাও যেন তদ্রুপ করোনা মোকাবিলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি, লকডাউন দিয়েছি, সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছি। করোনা আক্রমণ থেকে বাঁচলেও মানসিক বিষণ্নতায় ঘরে বসে আত্মহত্যা করছি।
মানব জীবনের জন্য খাদ্য এবং শিক্ষা উভয়েরই প্রয়োজন আছে। দেহের জন্য দরকার খাদ্য। আত্মার জন্য দরকার শিক্ষা। শিক্ষা না পেলে মানবাত্মা মারা যাবে। মানবাত্মা মারা গেলে মানুষ পশুর মত হবে। তাই শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রয়োজন আছে।
অতএব এক একদিন এক এক শ্রেণীর শিক্ষার্থীর জন্য নির্দিষ্ট করে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, শিক্ষার্থীদের বিভাজন করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিকট পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কাদিরদী ডিগ্রী কলেজ, বোয়ালমারী ফরিদপুর