কর্মমূখী সিলেবাস প্রণয়ন ও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের দ্রুত এমপিওভুক্তির দাবি
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্সের সিলেবাস বা শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নের আলোচনা জোরেশোরে চললেও বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়ে সরকার অনেকটা নিরব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্তির বিষয়ে মুখ না খোলায় শিক্ষকরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
শিল্প বিপ্লবের যুগে শিক্ষার্থীদের বিশ্ব চাকরির বাজার উপযোগী দক্ষ করে গড়ে তুলতে কর্মমূখী ও বৃত্তিমূলক কোর কোর্স চালু করা হবে যা বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বলা হচ্ছে নতুন এই কারিকুলাম চালু হলেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে না। শিক্ষকরা চাকরি হারাবেন না। কারিগরি কোর্স পড়াতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এরই মধ্যে নতুন কারিকুলাম তৈরিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১৫ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ৩১৫টি বেসরকারি কলেজের উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষকদের দীর্ঘ ২৯ বছর থেকে এমপিওভুক্তির যৌক্তিক দাবিটি উপেক্ষিত রয়েছে।
যেহেতু চার বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স বা তিন বছরের স্নাতক কোর্সের মূল বিষয়ের সঙ্গে টেকনিক্যাল অথবা জব ওরিয়েন্টেড সাবজেক্ট এর একটা পুল অব কোর্স থাকবে, সেহেতু শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদে রুপান্তরিত করার কারিগরদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা (এমপিও) দিতে হবে। অন্যথায় সরকারের এই মহতি উদ্যোগ সফল হবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে কর্মমূখী ও চাকরির বাজার উপযোগী করার উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে না, দেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না যদি শিক্ষকরা অভুক্ত থাকেন।
বিশ্বমানের শিক্ষার জন্য যেভাবে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে কারিকুলাম পরিবর্তন- পরিমার্জন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার, ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষকদের আর্থসামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরী।
শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় গণমাধ্যমে বারবার বলেছেন, কোনো শিক্ষকের চাকরি যাবে না। আমরা শুধু এই শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে রি-অর্গানাইজ করবো। এটা কর্মোপযোগী ও উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ মাত্র।
কিন্ত মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে বিনীতভাবে প্রশ্ন রাখতে চাই বিনা বেতন বা নামমাত্র বেতনের চাকরি থেকে লাভ কি? জনকল্যাণে সরকার যেকোন নীতিই গ্রহণ করতে পারে- এটাতে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সুস্পষ্ট ঘোষণা চাই, এমপিও নীতিমালা পরিবর্তন চাই। আমাদের চাকরি আছে, বেতন নেই। বর্তমানে কোভিড-১৯ এর তান্ডবে শিক্ষকরা দিশেহারা এবং মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যে চাকরিতে বিধিমোতাবেক নিয়োজিত শিক্ষকরা সরকারের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধুকেধুকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেই আধমরা শিক্ষকরা কিভাবে ক্লাসের পাঠদানে মনোযোগ দিবেন? কিভাবে শিক্ষার্থীদেরকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলবে? দেশের প্রায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে কিন্ত সেগুলোতে কি শিক্ষার্থীদের তুলনায় পর্যাপ্ত আসন রয়েছে?
প্রতি বছর দেশে ১২ থেকে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সীমিত থাকায় শিক্ষার্থীরা মেধা,আগ্রহ ও প্রবণতার ভিত্তিতে বেসরকারি পর্যায়ের ভালোমানের কলেজে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তির অযোগ্য শিক্ষার্থীরাই কলেজগুলোতে অনার্স ডিগ্রি লাভ করছে, এরকম মন্তব্য ঠিক নয়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে অনার্স বা মাস্টার্স শিক্ষার দরকার না থাকলে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে কোন ভিত্তিতে? হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশগুলোর মান নিয়ে সংশয় থাকলেও, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজগুলো থেকে সনদধারী বেকার তৈরি হচ্ছে মন্তব্য করাটা কতটুকু বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক তা বোধগম্য নয়। নাকি এমপিওভুক্তির দাবির কারণে এসব মন্তব্য আসছে?
দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে ঢালাওভাবে অনার্স গ্রাজুয়েটদের দোষারোপ করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত হওয়া মানেই একটি ভালো চাকরি পাওয়া বুঝায় না। সিলেবাস পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের মাঝে এই প্রবণতা তৈরি করতে হবে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠবার প্রেষণা দিতে হবে। একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শেখায়,আত্ননির্ভরশীল হবার সুযোগ সৃষ্টি করে।আমরা জানি যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত।শিক্ষার্থীদের জীবনের ভিত যারা রচনা করেন, তাদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি অবহেলা না করে বরং বৈষম্য কমাতে এগিয়ে আসা সরকার তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একই প্রতিষ্ঠানে দ্বৈত নীতি চলতে পারে না।
একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে, একই রকম কাজ করিয়ে নিয়ে শিক্ষকদের নন-এমপিও রাখার কালো বিধি পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারিভাবে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু রাখলে বিধিমোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেতনের (এমপিও) দায়িত্ব নিতে হবে।