০২ জুলাই ২০২১, ২২:২১

চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছর, চীনের উত্থান

মো. নিজাম উদ্দিন  © ফাইল ছবি

এক.
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) তার প্রতিষ্ঠার একশো বছর পালন করছে চীনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন প্রতিষ্ঠিত হয় সেদিনই চীনে বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টিকারী চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই চীনের সাংহাই শহরে সমাজতান্ত্রিক এই রাজনৈতিক দলের পথচলা শুরু।

মাত্র তেরো জন সদস্য নিয়ে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু, সেই তেরো জনের একজন ছিলেন মাও সে তুং। আল জাজিরার তথ্য মতে, বর্তমানে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা প্রায় নয় কোটি বিশ লাখ। যা চীনের মোট জনসংখ্যার ছয় দশমিক ছয় পার্সেন্ট। ষোল কোটি সদস্য নিয়ে ভারতের বিজেপি বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল।

একটা রাজনৈতিক দলের একশো বছর স্বগৌরবে টিকে থাকা খুব সহজ ব্যাপার নয়।বর্তমানে চীনের যে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং সামরিক অগ্রগতি তা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিরই চিন্তার ফসল। সিসিপির একশো বছরের পথ চলা নির্ভুল নয়, আছে তীব্র আলোচনা, সমালোচনা, নিন্দা, প্রশংসার ছড়াছড়ি।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব বাড়ছে, সামরিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার এক কমন মার্কেটে পরিনত হচ্ছে চীন। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে কিভাবে একটা কমিউনিস্ট পার্টি পৃথিবীর তাবৎ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে ঠিকে আছে, এগিয়ে যাচ্ছে? সে প্রশ্ন তুলছে তামাম দুনিয়া।

বাংলাদেশের জন্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক গতিবিধি খেয়াল রাখা জরুরী, চীনকে গুরুত্ব দিলেই বাংলাদেশ আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার ভারসাম্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে। ভূরাজনৈতিক এবং পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় এ অঞ্চলের রাজনীতি বিগত দুই তিন দশক যাবত অনেক বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে।

দুই.
১৯২১ থেকে ১৯৪৯ সাল। এই সময়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জিং সময় অতিবাহিত করে। আলোচিত লং মার্চ কর্মসূচীতে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে লাখো মানুষের অংশ গ্রহণে পাহাড় সমতল পেরিয়ে আট হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। চিয়াং কাইশেকের কুয়োমিনটাং পার্টির বিরুদ্ধে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং চীনের মূল ভূখণ্ডে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

গৃহযুদ্ধের সময়কালে চিয়াং কাইশেকের কুয়োমিনটাং পার্টির ঘাটি ছিল শহর কিন্তু মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির ঘাটি ছিল গ্রাম, তাই মাও সে তুং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। ওই সময়ে Nationalists had more modern equipment but the Communists had better generals. ফলে চিয়াং কাইশেক পরাজিত হন,মাও সে তুং সফল হন।

১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সেই বিপ্লবের প্রভাব পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র গুলোতেও যে পড়েছিল তার বাস্তব প্রমাণ ১৯২১ সালের চীনে সিসিপি প্রতিষ্ঠা।চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা রুশ বিপ্লবের একেবারে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বরং ধারাবাহিকতা। দেশ ভিন্ন হলেও আদর্শের বন্ধন রুশ ও চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তবে রুশ বিপ্লবের সাথে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল।

রাশিয়ায় রুশ বিপ্লবের মূল শক্তি ছিল শ্রমিক শ্রেণি, তাদের কেন্দ্র ছিল শহর কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি ছিল কৃষক এবং বিপ্লবের কেন্দ্র ছিল গ্রাম। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করা। গ্রামের অবহেলিত কৃষকরাও যে একটা রাষ্ট্রের সফল বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে এটা সিসিপি চীন বিপ্লব সফল করে সমাজতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে।

যদিও চীনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক প্রশ্ন আছে। তবে সিসিপি চীনের সমাজের উপযোগী এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে যা চীনকে আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিনত করেছে। অদূর ভবিষ্যতে চীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে যে আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে এটা এখন আর গল্প নয়, বাস্তবতা।

বিগত একশো বছরে চীনের যত অর্জন এবং যত সমালোচনা তার সবার ভিত্তি মূল চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। চীনের কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক এবং স্থানীয় সরকারের সব নিয়ন্ত্রণ করে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। চীনের সফলতা এবং ব্যর্থতার দায় একমাত্র সিসিপির। চীনের বিগত একশো বছরের গল্প মানে কমিউনিস্ট পার্টির গল্প।

তিন.
চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির কাঠামোও সাধারণ রাজনৈতিক দলের মত নয়। সিসিপির প্রধানের পদবী হচ্ছে জেনারেল সেক্রেটারি। পদাধিকার বলে সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারিই চীনের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।বর্তমান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং ২০১২ সাল থেকেই চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মাও সে তুং এর পর চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংকেই সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয়।২০১৮ সালে শি জিং পিং এর রাজনৈতিক চিন্তাকে চীনের সংবিধান সংশোধন করে তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তিনি সম্ভবত আজীবন চীনের প্রেসিডেন্ট থাকার পথ তৈরি করছেন।

শি জিং পিং এর রাজনৈতিক চিন্তাকে ‘চাইনিজ ড্রিম’ হিসাবে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে।সুতরাং শি জিং পিং চীনের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ব্যক্তি। জেনারেল সেক্রেটারির পরেই সিসিপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির নাম পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটি। যার সদস্য সংখ্যা মাত্র সাতজন। এই সাতজনই নয়কোটি বিশ লাখ সদস্যের রাজনৈতিক দল চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত নেয়। পলিটব্যুরো নামে পঁচিশ সদস্যের আরেকটি কমিটি আছে যেখান থেকে সাতজনকে পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির জন্য মনোনীত করা হয়।

সিসিপির সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৩৮০ জন। পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত সিসিপির ন্যাশনাল পার্টি কংগ্রেসে দুই হাজার তিন শত সদস্য ডেলিগেট হিসাবে অংশ নেয় তবে এটা বাড়ে কমে সময় বেধে। এছাড়া রয়েছে পার্টির শক্তিশালী গবেষণা সেল। পররাষ্ট্র সেল। প্রোপাগাণ্ডা সেল সহ আরো কয়েকটি কমিটি রয়েছে।চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি এবং সরকারকে আলাদা করা কঠিন। সরকার আর দল মিশে একাকার। সিসিপির চেইন অব কমান্ড অত্যন্ত শক্তশালী রাজনৈতিক দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত।

চার.
চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চিয়াং কাইশেকের কুয়োমিনটাং দলকে পরাজিত করলে চীনের গৃহ যুদ্ধের অবসান হয়।বেইজিংয়ে মাও সে তুং ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনা রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন ১৯৪৯ সালে। চিয়াং কাইশেকের বাহিনী তাইওয়ানে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই সময় থেকে বাহাত্তর বছর যাবত চীন শাসন করে আসছে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি।

তবে সিসিপি সমাজতান্ত্রিক দল হলেও শুধু মার্ক্সবাদকেই অনুসরণ করে না।চীন এখন যা অনুসরণ করে তাকে শুধু মাত্র সমাজতন্ত্রও বলা যাবে না। এটাকে socialism of chinese characteristics -বলা হয়ে থাকে। রুশ সমাজতন্ত্রের সাথে মাওবাদ এবং বাজার অর্থনীতির এক জটিল সমন্বয়ে চলছে চীনা সমাজতন্ত্র। এটাকে সমাজতন্ত্রও বলা যাবে না বরং সমাজতন্ত্রের একটা পুঁজিবাদী রুপ! যা চীন তার দেশে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন নেতা যারা পার্টি ও চীনের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন তারা হলেন মাও সে তুং, দেং জিয়াও পিং এবং শি জিং পিং। মাও সে তুং এর মৃত্যুের পর চার কুচক্রী মহলকে দমন করতে দেং জিয়াও পিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এমনকি চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় মাও সে তুংয়ের স্ত্রীকেও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। যদিও তা কার্যকর করা হয়নি।

সিসিপির ইতিহাসে দেং জিয়াও পিং এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন যিনি সম্ভবত প্রথম অনুধাবন করেন যে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিতে সংস্কার প্রয়োজন। তিনিই বলেছিলেন- বিড়ালটা সাদা কী কালো তা দেখার বিষয় নয়, বিড়াল ইদুর মারে কি না তাই দেখার বিষয়। দেং জিয়াও পিং ছিলেন একজন আধুনিক মনস্ক সমাজতান্ত্রিক নেতা।

তিনি সমাজতান্ত্রিক চীনের সাথে পুঁজিবাদের সমন্বয়ের সমাজতন্ত্র চাইলে তাকে পুঁজিবাদের দালাল আখ্যা দিয়ে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেং জিয়াও পিং সত্যে এ পরিনত হলেন। তিনি বলেছিলেন- poverty is not socialism, to be rich is glorious. রুশ বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, তারাও সংস্কার চেয়েছিল কিন্তু তারা করেছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার।

প্রেসিডেন্ট গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নে গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকার (খোলামেলা আলোচনা) নামে যে সংস্কার শুরু করেছিলেন তাও চীনের দেং জিয়াও পিং এর সংস্কারের অনুসরণে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করতে গিয়ে সমাজতন্ত্র ও দেশ কোনোটাই রক্ষা করতে পারেননি।

সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটোই ভেঙে যায়।কিন্তু চীন করেছিল শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার।যার কারণে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এখনো ব্যর্থ হয়নি।বহুদলীয় গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের কবর রচনা করে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রীরা এটা বুঝতে পারেনি যা চীন বুঝছে সক্ষম হয়েছে।এজন্যই চীন রাজনৈতিক ব্যাপারে কট্টর, অর্থনৈতিক ব্যাপারে উদার।

পাঁচ.
চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছরে মানুষ শুধু উন্নয়নই দেখছে না, আছে তার অনেক অন্ধকার দিকও। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে মাও সে তুং এবং তার উত্তরসুরী শাসকদের কমিউনিস্ট পলিসির চরম সমালোচনাও হচ্ছে। গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড নামে এক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন মাও সে তুং বিপ্লবের পর। তার উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদন বাড়ানো, কৃষি ও শিল্পের বিপ্লব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিন্তু ১৯৫৮-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চলা এই কর্মসূচীতে না খেয়েই প্রায় সাড়ে তিন থেকে চারকোটি মানুষ মারা যায়।

চীনের সামন্ততান্ত্রিক সাংস্কৃতিক চিন্তার বিলোপ সাধন করে সমাজতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধনের লক্ষে মাও সে তুং যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিয়ে ছিলেন সেখানেও প্রায় দুইকোটি মানুষ মারা যায়। তরুণদের নেতৃত্বে রেড গার্ড গঠন করলে সুশীল বুদ্ধিজীবী এবং সামন্ততান্ত্রিক চিন্তার মানুষদের উপর নির্যাতন নেমে আসে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,বিজ্ঞানী সহ সমাজের শিক্ষিত মানুষ গুলোকে জোর করে গ্রামে পাঠানো হয়।গ্রামে যেতে বাধ্য করা হয়।অথচ তাদের কাজ ছিল শহরে। ১৯৮৯ সালে বেইজিং এর তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবীতে বিক্ষোভ শুরু করলে সিসিপি তা কঠোর হাতে দমন করে।কয়েক হাজার বিক্ষোভ কারী সেখানে নিহত হয়।

চীনে মানবাধিকার, মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার, মুক্ত বুদ্ধির চর্চা চরমভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ করে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের উপর চলছে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন। ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। হংকং এ গণতন্ত্রী পন্থীদের উপর চলছে নির্যাতন।

প্রশ্ন আছে তিব্বতিদের ব্যাপারে চীনের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির! তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন দেশ মনে করলেও চীন মনে করে তাইওয়ান চীনের অংশ! করোনা ভাইরাসের শুরুটা চীনের উহানে হওয়ার মার্কিনিরা এটাকে চাইনিজ ভাইরাস নামেও ডাকে, দায় চাপাতে চায় চীনের উপর।পাশ্চাত্য মিডিয়া চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা নিয়ে সব সময় সরব থাকলেও কমিউনিস্ট চীন সব সময়েই এসব দাবী অস্বীকার করে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এগুলোর সব অস্বীকারের সুযোগও নেই। চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নয়নের ছায়ায় রাজনৈতিক কালো অধ্যায়গুলোকে ঢেকে দেওয়ার জায়গা নেই।

ছয়.
চীনে মাও সে তুং এর পর সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মনে করা হয় বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংকে।তিনি প্রাচীন সিল্ক রোডের আদলে এমন এক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন যা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নামে পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয় বহুল প্রকল্প বলা হচ্ছে এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পকে। এর মাধ্যমে সড়ক পথে চীন এশিয়া ও ইউরোপের ষাটটি দেশের সাথে সরাসরি যুক্ত হবে।

এই প্রকল্প আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত সহ চীনের রাজনৈতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। চীনে ‘এক দেশ, দুই নীতি’ থাকলেও তাইয়ানকে এখন চীনের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।নিউইয়র্ক টাইমস বলছে-মাও সে তুং যদি দেশটাকে জন্ম দিয়ে থাকেন, দেং জিয়াও পিং দেশটাকে সমৃদ্ধশালী করেছেন আর শি জিং পিং চীনকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন (২৪ অক্টোবর ২০১৭)।

বৃদ্ধ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং জন্মহার কমে যাওয়ায় চীনে এক সন্তান নীতিও এখন তুলে দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অতীতে চীন কোনো দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা না বললেও এখন সেদিকেও চোখ রাখছে। বিশেষ করে সিরিয়ায় চীন রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাশার আল আসাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। না হয় বাশার আল আসাদকে অনেক আগেই আমেরিকা শেষ করে দিত।কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চীন আছে।

ভেনিজুয়েলায় কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সরকারের পতন ঘটাবার জন্য আমেরিকা ও পাশ্চাত্য শক্তি গুলো উঠে পড়ে লেগেছিল কিন্তু চীন মাদুরোর পাশে দাঁড়ায়।ফলে মাদুরো সরকার ভেনিজুয়েলায় রক্ষা পায়। ইরানকে আমেরিকা কথায় কথায় হুমকি দেয়! অবরোধ করে!কিন্তু কেন ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পতন ঘটিয়ে একটা গণতান্ত্রি মার্কিন মডেলের সরকার ইরানে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না? উত্তর অবশ্যই চীন।

সম্প্রতি ফিলিস্তিন- ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতেও চীন ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছে(যদিও নিজ দেশের জিনজিয়াং এ মুসলিম নির্যাতনের বিষয়ে নিরব!)। ফলে ইসরায়েলকেও অনেক হিসাব নিকেশ করে এগুতে হচ্ছে।মিয়ানমারে যে সামরিক অভ্যুত্থানটা হলো কিছু দিন আগে সেখানেও চীন সরাসরি সামরিক সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

ফলে এনএলডি, অং সান সুচি কিংবা গণতন্ত্র পন্থীদের লড়াইটা তাই খুব জটিল হচ্ছেনা মিয়ানমারে, যদিও আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য দুনিয়া মিয়ানমারে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাস্তবতা। চীন গণতন্ত্র নাকি সামরিক তন্ত্রের পক্ষে বিষয়টা তা নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন বিভিন্ন দেশে চীনের হস্তক্ষেপ বাড়ছে যা আগে খুব একটা দেখা যায়নি। এজন্যই অনেকের প্রশ্ন একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে চীন কি রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে?

সাত.
চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি এমন এক সময়ে তার প্রতিষ্ঠার একশো বছর উদযাপন করছে যখন আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে তার সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো সরাসরি বাণিজ্য যুদ্ধই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন চীনের বিরুদ্ধে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কোনো রাখঢাক না করেই বলছেন তিনি এখন চীনের দিকে নজর দেবেন।

এশিয়াকে বলা হচ্ছে নিউ সেন্টার অব দি ওয়াল্ড। চীনকে বলা হচ্ছে প্রোডাকশন মেশিন অব অব দি ওয়ার্ল্ড। সুতরাং আগামী দিনগুলোতে পৃথিবীকে এককভাবে চ্যালেঞ্জ করবে চীনই। আমেরিকা যখন দেশে দেশে যুদ্ধ বাধাতে ব্যস্ত চীন তখন গুরুত্বপূর্ণ দিচ্ছে চীনা পণ্যের বাজার। চীন পণ্য রপ্তানি করেছে, তার সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শন রপ্তানি করেনি।

তবুও মাওবাদ বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, নেপাল, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশে অতীতে প্রভাব বিস্তার করে ছিল যদিও এখন তেমনটি নেই। চীন,মার্কিন গণতন্ত্র রপ্তানির মতো তার সমাজতন্ত্র রপ্তানির চিন্তা তেমনটা করেনি। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এখন মনে হচ্ছে রাজনীতির দিকে নজর দিচ্ছে।

কোনো দেশে চীনা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সেই দেশ নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে চীন সেই দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে থেকেই নিয়ন্ত্রণের পথ বের করে নিচ্ছে।আমেরিকার বর্তমান যে অবস্থা সেখানে চীনের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে চীনই বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে।দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিরও একটা আমূল পরিবর্তন দেখা যাবে তখন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক