০২ জুলাই ২০২১, ০০:০১

একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কতিপয় বাস্তব পরাবাস্তবতা

ঢাবির শতবর্ষ  © টিডিসি ফটো

১ জুলাই সমগ্র বাংলার জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। বঙ্গভঙ্গ রদ এপার বাংলার মুসলিম জনগণকে পুরোপুরি হতাশ করলেও নবাব সলিমুল্লাহ্ খানের তৎপরতায় ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নতুন যুগের সৃষ্টি করে। পিছিয়ে পড়া মুসলিম বাঙালিদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলোকিত হওয়ার, নিজেদের দুর্দশা কাটিয়ে অগ্রগতি সাধনের মাধ্যম হয়ে দেখা দেয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চা থেকে শুরু করে পরমতসহিষ্ণুতার মতো অসাম্প্রদায়িক গুণাবলি অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে অনন্য প্রতিষ্ঠান।

গত কয়েক দশকের হিসেব বাদ দিলে একশো বছরের যাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ উৎকর্ষতাই সাধন করেছে। কিন্তু এই কয়েক দশকের অন্ধকারাচ্ছন্ন যাত্রাটিই যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত উৎকর্ষতাকে গ্রাস করে ফেলতে সক্ষম। উপলব্ধির জায়গায় এখনো পরিপক্ব হয়ে ওঠতে পারিনি, তবে এই স্বল্প জ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান অবস্থানকে এক করতে গেলে কিছুতেই স্বস্তি আসে না। কেবল মনে হয়, আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক এ জায়গায় থাকার কথা ছিল না। কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকেই যায় প্রতিবার ভাবতে গেলে। এই বাস্তবতাটা মেনে নেয়ার মতো না, তবুও তাই ঘটেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটি এক প্রকার নিজেকে ডিপ্রেশনে ফেলে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়ার মতো ঘটনা। Avengers End Game মুভিটি যারা দেখেছেন তারা হয়ত খেয়াল করে থাকবেন, থর অব ওডিনসন পরিবার পরিজন হারিয়ে মেতে ওঠেছিল খাবার দাবার আর ড্রিংকিং এ। বিদঘুটে মেদবহুল একটা শরীর হয়েছিল তার। ঠিক একই অবস্থা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও। বিজ্ঞজনরা হয়ত উপমায় আমার আনাড়িপনা দেখে হাসাহাসি করে থাকবেন, কিন্তু তারপরও বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি মার্ভেল সিনেম্যাটিক য়্যুনিভার্সের সেই ডিপ্রেসড থর হিসেবেই দেখি। থরের মতো অসম্ভব কিছু করে ফেলার শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে, তার প্রমাণ আমরা যুগে যুগে দেখেছি, কিন্তু সেই অসম্ভব কিছু করে ফেলার শক্তিটা স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে আর ততটা প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি।

অবশ্যই এসবের পেছনে অনেকগুলো বিষয়ের হস্তক্ষেপ আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে অবনতির দিকে নিয়ে যাওয়াটা খুব সহজ কাজ নয়। প্রতিটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম মশাল জ্বলে ওঠত যে প্রাঙ্গনে, পুরো তল্লাটে মেধা, মনন ও জ্ঞানের উৎকৃষ্ট সাধনার সূত্রপাত হয়েছিল যে প্রতিষ্ঠান থেকে, সেই প্রতিষ্ঠানকে এসব গ্রেট ওয়ার্ক থেকে ডিস্ট্রাক্ট করাটা মোটেও চাট্টিখানি কথা না। তবে কেন এমনটা হলো?

মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য দখলের যুদ্ধগুলোতে আক্রমণকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকত রাজধানী ও সেখানকার রাজপ্রাসাদকে করায়ত্ত করা। ব্যাপারটা এমন যে, রাজপ্রাসাদ দখল মানে পুরো সাম্রাজ্য দখল। ঠিক এ কারণেই মোটামুটি সব সাম্রাজ্যই নিজেদের রাজধানী এবং সেখানকার রাজপ্রাসাদকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে আগলে রাখতে চাইত। কিন্তু তারপরও তো সেই রাজপ্রাসাদই থাকত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, যার গুরুত্ব যত বেশি, তার দখল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিটাও ঠিক তত বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার খাটানো যায়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়গুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার পরও অতিরিক্ত একটা শঙ্কায় থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। একে রাখতে চায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তায়।  কিন্তু তাতে যে প্রতিষ্ঠানের নিজস্বতা বিলীন হয়ে যায়, স্বায়ত্তশাসন শব্দটা অকেজো হয়ে যায়, তার দিকে আর নজর থাকে না কারোরই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবনতির প্রধানতম কারণ এই স্বকীয়তার অভাব। এই স্বকীয়তাটা গত কয়েক দশক ধরে ধীর গতিতে হারিয়েছে, আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফলাফলটা প্রকট হয়েছে এই কিছুদিন হলো।

এবার কিছু পরাবাস্তবতার কথা ভেবে দেখা যাক, যেসব পরাবাস্তবতাগুলো সত্যি সতি বাস্তব হতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞানচর্চাটা যদি গত একশো বছর ধরে হয়ে আসত, বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব ছন্দ ও সংজ্ঞার উপর চলতে পারত, তাহলে তার সুফল ভোগ করতে পারত পুরো বাংলাদেশ। সত্যি বলতে পুরো একটি দেশকে বদলে দেওয়ার জন্য শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই যথেষ্ট। বছরের পর বছর গবেষণা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বিজ্ঞান, কলা ও শিল্পের উপর হস্তক্ষেপ মুক্ত প্রণোদনা এবং ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাই পুরো বাংলাদেশকে একটি প্রথম শ্রেণির দেশে রূপান্তর করতে সক্ষম। এই পরাবাস্তবতাকে বাস্তব করে তুলতে সবার আগে প্রয়োজন একটি বৃহৎ মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। প্রয়োজন লেজুড়বৃত্তির অবসান, উপরমহলের সদিচ্ছা, ব্যক্তিস্বার্থ পরিহার করে সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনা করার মানসিকতা ও একটি দক্ষ ও কার্যকর পরিকল্পনা। এই ব্যাপারগুলো যতদিন না ঘটবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ অবনতির দিকেই এগোবে, আমরা সেটা মানতে পারি কিংবা না পারি।

থরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবারও তার পুরনো রূপে ফিরে আসবে, এখান থেকেই শুরু হবে মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লব- বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে তার একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।