ছাত্র অর্থনীতি
- ড. এ. এইচ. এম. কামাল
- প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২১, ০৭:৪৯ PM , আপডেট: ০১ জুলাই ২০২১, ০৭:৪৯ PM
দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করার জন্য অর্থনীতির খণ্ড খণ্ড সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোর আলাদা আলাদা ব্যবস্থাপনা ও বিকাশের জন্য দেশের টোটাল অর্থনীতিকে উপভাগে ভাগ করা হয়। যেমন: পর্যটন অর্থনীতি, শিক্ষা অর্থনীতি (বৈদেশিক শিক্ষার্থীর টিউশন ফি হতে আয়), চিকিৎসা অর্থনীতি (বিদেশীদের চিকিৎসা সেবা গ্রহণ উপলক্ষ্যে আয়), কৃষি অর্থনীতি, শিল্প অর্থনীতি, নীল অর্থনীতি এরকম করে অর্থনীতির আরও নানান ধারা তৈরি করা হয়।
তাঁর মধ্যে নীল অর্থনীতি আমাদের দেশের জন্য নতুন একটি শব্দ। নীল অর্থনীতি মানে সাগরের বিভিন্ন সম্পদ থেকে করা আয়। তেমনি অনুল্লেখ্য একটি ধারা আছে যাকে ছাত্র অর্থনীতি বলা যেতে পারে।
ছাত্র অর্থনীতি মূলত বাজার অর্থনীতির একটি অঙ্গ। এটি অন্য বাজার অর্থনীতির সাথে এমনভাবে মিশে আছে যে সেটিকে আলাদা করে কেউ খেয়াল করেনি। অথচ ক্ষেত্রটি বিশাল। তাহলে আসুন এ সম্পর্কে জেনে নেই।
ছাত্র অর্থনীতি বলতে ছাত্রদের টিউশনকে বুঝাচ্ছি না। টিউশনকে শিক্ষা অর্থনীতির সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়। ছাত্র অর্থনীতি বলতে আমি আসলে ছাত্রদের জীবন-যাপনের জন্য ব্যয়িত টাকার অর্থনীতিকে বুঝাচ্ছি। সরকারি, বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মিলে দেশে প্রায় ১২ লক্ষ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী আছে।
খাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা, শিক্ষা সামগ্রী ক্রয়, যাতায়াত, ইন্টারনেট ব্যয় ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ গড়ে প্রতি মাসে শিক্ষার্থী প্রতি একজন অভিভাবক ৫০০০টাকার ঊর্ধ্বে খরচ করেন। এই টাকা টিউশন ফি ছাড়াই তারা খরচ করেন।
আমার ধারণা, সময়ে সময়ে করা কিছু বড় ব্যয় (যেমন, মোবাইল, ল্যাপটপ, ফ্যান, চিকিৎসা, ইত্যাদি) আমলে নিলে সেই খরচ মাসে ৭০০০টাকার কম হবে না। তবুও ৫০০০টাকাকে মাসিক ব্যয় ধরে দেখানো যায় যে দেশের শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাসে টার্ন ওভার করে ৬০০০০০০০০০টাকা, মানে ৬০০কোটি টাকা। তাদের কেনাকাটা করা বেশিরভাগ দ্রব্যের ক্ষেত্রে ভ্যাটের পরিমাণ ১০% যা সরকার ক্রয়ের সময়ে আদায় করে।
আবার শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত কিছু বিদেশী দ্রব্য বা দেশীয় দ্রব্য হলেও তাদের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা বাবদ সরকার ট্যাক্স পায়। ট্যাক্সের পরিমাণ গড়ে ১৫%। তবে সব পণ্য যেহেতু বিদেশ থেকে আসেনা তাই সকল পণ্যের জন্য ট্যাক্স দিতে হয় না। ধরি তাদের কেনা ২৫% দ্রব্যের জন্য ট্যাক্স দিতে হয়। তাহলে গড়ে ট্যাক্স বসে ১৫*০.২৫%=৩.৭৫%।
এবার বলা যেতে পারে যে এই ট্যাক্স তো কোম্পানি দিচ্ছে। তাতে ক্রেতার কি? অবশ্যই আছে। কোম্পানি ট্যাক্স দেয় বলেই দ্রব্যের দাম বাড়ে। অন্যভাবে, ক্রেতা দ্রব্য কিনে বলেই কোম্পানি ট্যাক্স দিতে পারে। তাই ট্যাক্সকেও আমলে নেওয়া হলো।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্য কেনাকাটা করতে যেয়ে সারচার্জ দিয়ে আসতে হয়। আবার ক্রেতারা কেনাকাটা করলে ব্যক্তি বা কোম্পানির সম্পদ বাড়ে। সেক্ষেত্রে বড় সম্পদের জন্য সারচার্জ দিতে হয়। অথচ ক্রেতারা কেনে বলেই ব্যক্তি বা কোম্পানির সম্পদ বাড়ে। আর তাদের দেওয়া সারচার্জ কোন না কোন ভাবে ক্রেতার কাছ থেকে তুলে নেয়।
তাই ভোক্তা পর্যায়ে দামে প্রভাব পড়ে। সেই দিক বিবেচনায় মোট ব্যয়ের ২৫% সারচার্জ এর জন্য বিবেচনায় নেওয়া হলো। তাতে করে সারচার্জের পরিমাণও ৩.৭৫% হয়ে যাবে। তাহলে ভ্যাট+ট্যাক্স+সারচার্জ বাবদ সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট হতে আদায় হয় শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের (১০+৩.৭৫+৩.৭৫)%=১৭.৫% যা টাকার মূল্যে আনুমানিক ৬০০কোটি এর ১৭.৫%, অর্থাৎ ১০৫ কোটি টাকা। এবার যদি বাৎসরিক হিসাবে আসি তাহলে মোট আদায় দাঁড়ায় ১২৬০ কোটি টাকা।
উপরের আলোচনায় আলোকপাত করলে বুঝা যাবে যে সরকার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট হতে টিউশন ফি ব্যতীত বছরে ১২৬০ কোটি টাকা আয় করেন। সত্যিকারের হিসাব এর চেয়ে বড় হবে। ভ্যাট, ট্যাক্স ও সার্চার্জ ছাড়া যে হিসাব দেখানো হয়েছে, সেগুলোও পরোক্ষভাবে ভ্যাট, ট্যাক্স ও সার্চার্জের আওতায় চলে আসে। সেসব আমলে নিলে সহজেই দেখানো যাবে যে সরকারের আয় আরও বেশি হচ্ছে।
উক্ত হিসাবের বাহিরে আছে দেশের শিশু শ্রেণি হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী আছে। যেহেতু এই স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয় এবং প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা রয়েছে তাই তাদের ব্যয় গড়ে ৫০০টাকা করে ধরা যেতে পারে (অতি নগণ্য ধরা)।
তখন সেই সকল শিক্ষার্থীদের জন্য মাসে দেশে যে পরিমাণ টাকার হাত বদল হয় তার পরিমাণ ৪*৫০০ কোটি টাকা=২০০০ কোটি টাকা। সুতরাং বছরে ব্যয় ২৪০০০ কোটি টাকা। তা থেকে সরকারের আয় ১৭.৫%=৪২০০ কোটি টাকা। সব মিলে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের কাছ হতে সরকারের আয় বছরে ৫৪৬০ কোটি টাকা।
কাজেই এটা কোন ছোট অর্থনীতি নয়। আমার ধারণা, করোনাকালে সরকার ভালই বুঝতে পারছে যে তাঁরা ছাত্র-অর্থনীতি হতে কতটুকু বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের উচিত এই খাতে নজর বাড়ানো। বিদেশী শিক্ষার্থী আকর্ষণ করেও এই আয় বাড়ানো যেতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়