শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্তমান বাস্তবতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯২১ সালের ১লা জুলাই। শত বছরের এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে হবে ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। নানা বিরোধীতার মধ‌্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একটি জাতি বিনির্মাণে যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা পালন করতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উদাহরণই আছে আর তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার প্রমাণ বিশ্ববাসী দেখেছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ এ মহান যুদ্ধের অগ্রনায়কদের বেশিরভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা।

এরপর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ছিলেন সম্মুখ কাতারে। সর্বশেষ ১/১১'র বিরোধী আন্দোলনেও এগিয়ে আসতে দেখা গেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সবকটি আন্দোলনেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গর্ব করার মতো একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। তাই হয়তো সাম্প্রতিককালে এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা সমালোচনা। আর এসব সমালোচনার যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।

স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা দুঃসময়ে জাতির কল্যাণে অতীতের মতোই এগিয়ে আসবেন। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ব্যর্থ । হতাশ হতে হয়েছে জাতিকে। তারা উল্লেখযোগ্য কিছু করেছেন এমনটা দেখা যায়নি। করোনাকাল বাদ দিলে পত্রিকার পাতা খুললে যেসব বিষয়গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায় তারমধ্য উল্লেখযোগ্য হলো- শিক্ষার্থীদের মধ্য মারামারি, গণরুমের দৃশ্য, গেস্টরুমে নির্যাতন, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষকদের গবেষণা চুরি, টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ে দু পক্ষের মধ্য ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াসহ প্রভৃতি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ভালো কিছু হয় না ? অবশ্যই হয়। তবে তা উল্লেখ করার মতো নয়। 

একথা সকলেই মানবেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার গৌরব ধরে রাখতে পারেনি। এখন দেখা যায় যে, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্থান পৃথিবীর এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য নেই। তার মানে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা মেধাবী নন ? অবশ্যই মেধাবী। তবে পদ্ধতিগত ভুলের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কোন শিক্ষার্থী যদি একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তবে জীবনে একটি বই না পড়েও অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে যাবেন যদি তিনি পূর্বের শিক্ষার্থীদের পুরাতন কিছু নোট পড়েন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস কত বছর পূর্বে করা হয়েছে তা বলা মুশকিল। আর পরীক্ষা পদ্ধতিও সনাতন। এ পদ্ধতি বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। বই না পড়েও অনেকেই আবার প্রথম শ্রেণি পান এবং তারাই শিক্ষক হন যদি তারা উচ্চতর লবিং বজায় রাখতে পারেন বা দলীয় তকমা অর্জন করেন। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় লবিং বা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট থাকলেও সমস্যা নেই। আবার দেখা যায়,  খুব ভালো রেজাল্ট করেও অনেকেই নিয়োগ পান না লবিং বা দলীয় তকমা না থাকার কারণে।

এমনকি বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকলেও তারা নিয়োগ পাননা। অভিযোগ আছে যারা একবার থোক হিসেবে নিয়োগ পান তারা একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমের চেয়ে দলীয় লেজুড়ভিত্তিকে বেশি গুরুত্ব দেন। অনেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ বাদ দিয়ে কোন কোচিং বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কোন প্রকার পড়াশোনাই ছাড়াই অনেক শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে আসেন। খোশ-গল্প করেই শেষ করেন নির্ধারিত সময়। শ্রেণিকক্ষে কোন শিক্ষার্থী প্রশ্ন করল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন অনেক শিক্ষক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইংল্যান্ডের বিখ্যাত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা পিছিয়ে আছেন সবচেয়ে বেশি গবেষণায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী আছে তার সকালের দৃশ্য দেখলে মনে হবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লাইব্রেরীতে স্থান পাওয়ার জন্য একপ্রকার যুদ্ধ করছেন। ভেতরে গিয়ে দেখা যাবে সবাই বিসিএস বা অন্য কোন পরীক্ষার জন্য পড়ালেখা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল-পিএইচডি সম্পির্কত যে কক্ষটি রয়েছে তা দেখলে মনে হবে যুদ্ধ কবলিত কোন এলাকা। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাজার হাজার ফাইল। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় , তাদের করার কিছু নেই। উচ্চতর মহলকে বলার পরেও কোন কাজ হয়নি। 

আর শিক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার পর বিভিন্ন পদ-পদবির লোভে ভিসি অফিস বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আর ভিসি মহোদয় স্যার ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন বিভাগের নবীনবরণ, ফিতা কাটা বা সভা-সেমিনার নিয়ে। এসব কাজের জন্য বিভাগীয় প্রধান বা সর্বোচ্চ ডিনরাই যথেষ্ট। একজন বিশ্ববিদালয়ের ভিসির কাজ হবে পলিসি নিয়ে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হাজার বছর পিছিয়ে আছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। শিক্ষার মান বা গবেষণায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারে-কাছেও নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। করোনা মহামারিতে বিশ্ব এখন নিথর, নিস্তব্ধ। মানুষ দিশেহারা। জীবন যেন থেমে গেছে। মানুষকে আবার এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। করোনার টিকা আবিস্কারে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাপী নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ১০৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বব্যাপী টিকে আছে স্বমহিমায়। গবেষণা,  শিক্ষাদান, প্রযুক্তি সবকিছুতেই তার অবস্থান ঈর্ষা করার মতো। গাণিতিক হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৯২৫ বছর। এত দীর্ঘ সময় পরও বিশ্ববিদ্যালয়টি নুয়ে পড়ে নি। বৃদ্ধ হয়ে যায়নি গবেষণায়। পিছিয়ে পড়েনি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। 

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ? এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন স্থান নেই। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক কার্যক্রম চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে। করোনা মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি পরিচালনায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকই প্রযুক্তি  ব্যবহার করে পরীক্ষা ও পাঠদান চালু রেখেছে। তাদের নেই কোন সেশনজট।

বাংলাদেশের ভেতরে নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে হবে বহির্বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ।যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক সময়ে বা পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক দেরকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে পুরোপুরি মেধাকে প্রাধান্য দিতে হবে। গবেষণা কেও প্রধান্য দিতে হবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় কে রাখতে হবে জাদুঘরে। বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা, শিক্ষক নিয়োগ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে । হস্তক্ষেপের চেয়ে সহায়তামূলক ভূমিকায় সরকারকে হাত বাড়াতে হবে। 

 বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পদ্ধতির গবেষণা সংস্কার করতে হবে। এমফিল-পিএইচডি কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। চলার পথে সমালোচনা যাই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে তার আপন গতিতে এটাই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। জাতি গঠনে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতার ভূমিকায় থাকবে। 

গণতন্ত্র বিকাশে এগিয়ে আসবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। এদেশের বর্তমান ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে এগিয়ে আসবেন এ বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। সকল অনিয়ম-অবিচারের বিরুদ্ধে আবারও মাঝপথে দেখতে চাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক সবার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এসব প্রত্যাশা আমার একার নয়, পুরো দেশবাসীর, বাঙালি জাতির। সমালোচনাকে সাথে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাক তার আপন গতিতে।

লেখক: ব্যারিস্টার ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ


সর্বশেষ সংবাদ