বর্তমান প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষা পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন কতটা জরুরি?  

লেখক ও প্রতীকী ছবি
লেখক ও প্রতীকী ছবি  © টিডিসি ফটো

কোভিড-১৯ মহামারি আমাদেরকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, সাথে সাথে কিছু সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত করেছে। পৃথিবীর প্রায় সব সেক্টরই কম বেশি এই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত, শিক্ষা ক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। সারাজীবন যে শিক্ষকরা প্রচলিত টিচিং-লার্নিং এ অভ্যস্ত, তাদের পক্ষে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া ব্লেন্ডেড, অনলাইন বা ডিজিটাল এডুকেশনে ক্লাস নেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা সহজ নয়।

বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তাবৃন্দকে জীবন-জীবিকার তাগিদে বিকল্প রোজগারের পথ খুঁজতে হয়েছে, সেটা নার্সারি, প্রাথমিক বা উচ্চশিক্ষা– সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেকে বিকল্প রোজগারের পথ না পেয়ে মানবতার জীবনযাপন করছে।

আর দীর্ঘদিন ক্লাস ও পরীক্ষা না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হতাশা এবং বিপথে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আমরা ডিজিটালি অনেকদূর এগিয়েছে সত্যি কিন্ত উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো ডিজিটাল এডুকেশনের প্রয়োগ যেমনটি হওয়া উচিত ছিল, তা দেখতে পাইনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যেই সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং মেথডের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।

প্রথমেই আমরা ফেস-টু-ফেস, অনলাইন, ব্লেন্ডেড, ডিজিটাল এবং এই সম্পর্কিত বিষয়গুলো একটু পরিষ্কারভাবে জেনে নিই। প্রচলিত পদ্ধতিতে আমরা যেভাবে সরাসরি ক্লাসরুমে পাঠদান করায় সেটিকে ফেস-টু-ফেস এডুকেশন বলি, যেমন ক্লাসরুমে সরাসরি গিয়ে আমরা যে লেকচার দিই। ইন্টারনেটভিত্তিক যেকোনো পাঠদান পদ্ধতিকে অনলাইন এডুকেশন বলতে পারি, যেমন জুম বা গুগল মিট এর মাধ্যমে আমরা যে ক্লাস নিয়ে থাকি। আর ফেস-টু-ফেস এবং অনলাইন এডুকেশনের সংমিশ্রণকে আমরা ব্লেন্ডেড এডুকেশন বলতে পারি, যেমন সপ্তাহের পাঁচ দিনের ক্লাস শিডিউলের মধ্যে তিন দিন সরাসরি ক্লাসরুমে এবং দুইদিন অনলাইনে পাঠদান করলে সেটা ব্লেন্ডেড এডুকেশন। তবে যেকোনো ধরনের পাঠদান পদ্ধতিকে আমরা ডিজিটাল এডুকেশন বলতে পারি যদি সেটা ডিজিটাল প্রযুক্তি বা আইসিটি’র সাহায্যে পরিচালিত হয়, যেমন মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির মাধ্যমে সরাসরি কোন ক্লাস নিলে সেটা ডিজিটাল এডুকেশন। আর ব্লেন্ডেড বা অনলাইন এডুকেশন যেহেতু ডিজিটাল টেকনোলজি ছাড়া সম্ভব নয়, তাই উভয় পদ্ধতিই ডিজিটাল এডুকেশনের মধ্যে পড়ে।

বর্তমানে নতুন একটি কনসেপ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে ফিজিটাল এডুকেশন যা ফিজিক্যাল এবং ডিজিটাল এডুকেশনের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। এটি ব্লেন্ডেড এডুকেশন থেকে কিছুটা ভিন্ন, কারণ ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে ফেস-টু-ফেস এবং অনলাইন দুটিই পাশাপাশি চলে আর ফিজিটাল পদ্ধতিতে ফেস-টু-ফেস (ফিজিক্যাল) এবং অনলাইন (ডিজিটাল)দুটো পদ্ধতির সেরা প্রাকটিসগুলো ইন্টিগ্রেট করে পাঠদান করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, রোবোটিক্স ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের রোবোটের সাথে ইন্টার‍্যাকশন, একটি ক্লাসের এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রী সরাসরি এবং দুই-তৃতীয়াংশ অনলাইনে একই সময়ে ক্লাস করা - এক্ষেত্রে স্টুডেন্ট এনগেজমেন্ট এবং লার্নিং আউটকাম তুলনামূলক ভাল হয়। এডুকেশন৪.০ এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ফিজিটাল এডুকেশনই হবে ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা।

এখন মূল আলোচনায় আসা যাক। ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল এডুকেশনকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়াটাই আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্বল গতির ইন্টারনেট, আর্থ-সামাজিক অবস্থার নিরিখে ডিভাইস ও উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট ইস্যু, শিক্ষকদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনীহা, ডিজিটাল এডুকেশন সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারনা, এবং সর্বোপরি একটি সামষ্টিক ও গ্রহণযোগ্য ডিজিটাল এডুকেশন পলিসি’র অভাব – এদেশের সকল স্তরে ডিজিটাল এডুকেশন বাস্তবায়ন ও প্রসারের সবচেয়ে বড় বাঁধা। তবে সবার জন্যে ডিজিটাল এডুকেশন নিশ্চিত করতে হলে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে কেন্দ্রীয়ভাবে ম‍্যানেজড এবং কাস্টমাইজড লার্নিং ম‍্যানেজমেন্ট সিস্টেম(এলএমএস) যেমন মূডল, ক্যানভাস, ব্ল্যাকবোর্ড বা নূন্যতম গুগল ক্লাসরুম এর যেকোনো একটি অবশ্যই থাকা উচিত। এছাড়া সমস্ত একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, বাবস্থাপনা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্মার্ট-এডুকেশন টাইপের প্লাটফর্ম খুবই জরুরি।

শিক্ষক ও কর্মকর্তাবৃন্দ যাতে নিয়মিতভাবে এই প্লাটফর্মগুলো ব‍্যবহার করে তার জন্যে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের কোন বিকল্প নেই বিশেষ করে একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি প্রাকটিসের দূরত্ব নিরসনে এবং শিক্ষকদের নৈতিক মূল‍্যবোধ ও প্রফেশনালিজম তৈরিতে। এক্ষেত্রে ম‍্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্স (মুক) খুবই উপযোগী প্লাটফর্ম হতে পারে। শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা - এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখে ডিজিটাল এডুকেশন পরিচালনা করা উচিত। শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক নিয়মিত এনালিসিস করে সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়মিত পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষকদের প্রতি মাসে ন্যুনতম কয়েকটি বিষয়ের উপর একটি সামগ্রিক রিপোর্টিং জমা নেওয়া যেতে পারে স্মার্ট-এডুকেশন এর মতো প্ল্যাটফর্মে, যেগুলোর মধ্যে থাকবে স্টুডেন্ট ফিডব্যাক, রিসার্চ এক্টিভিটি, সেলফ ডেভেলপমেন্ট, অ্যাটেনডেন্স, স্টুডেন্ট এক্টিভিটি কমপ্লিশন, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি। এগুলোর উপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের মাসিক মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দিতে পারলে কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করা সহজ হবে।

দেশের কয়েকটি পাবলিক এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ডিজিটাল এডুকেশন সেক্টরে ভালো করছে যেমন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্রাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেসনালস। এর মধ্যে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিকে ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল এডুকেশনে বাংলাদেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে ধরা হয়। ২০১৩ সালে ব্লেন্ডেড লার্নি সেন্টার এর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল এডুকেশন শুরু করেছিলো ড্যাফোডিল। বর্তমানে নিজস্ব এলএমএস, মুক প্লাটফর্ম এবং স্মার্ট-এডু সিস্টেমসহ অসংখ্য সল্যুলশন নিয়ে টিচিং-লার্নিং পরিচালনা করছে শীর্ষ এই প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ কর্মসূচির অধীনে ৩০ হাজারেরও অধিক ল্যাপটপ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি ক্যানভাস এলএমএস এবং ব্রাক ইউনিভার্সিটি এডেক্স প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির মধ্যে বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেসনালস, শাহজালাল ইউনিভার্সিটিসহ আরো কিছু প্রতিষ্টান করোনা মহামারীর শুরু থেকে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম পরিচালনা করে আসছে।

অনলাইন এডুকেশনের সবচেয়ে বড় চ‍্যালেঞ্জ হলো এসেসমেন্ট পদ্ধতি। আমাদের দেশে মোট মার্কের বেশিরভাগ (৭০-৮০%) বরাদ্ধ থাকে সেমিস্টার ফাইনাল/মিড টার্ম পরীক্ষায় যা আধুনিক এসেসমেন্ট সিস্টেমের সাথে মোটেও মানানসই নয়। অন‍্যদিকে অনলাইনে প্রক্টরড এক্সামের সাফল্য আশাব‍্যঞ্জক নয়, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। এক্ষেত্রে মিক্সড পদ্ধতি কার্যকারী হতে পারে। ৬০-৭০% মার্ক অনলাইনে অথেনটিক এসেসমেন্টের মাধ্যমে হতে পারে, যেমন ধরেন ক্রিয়েটিভ এসাইনমেন্ট, কুইজ, কেস স্টাডিস, প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট ডেভলপমেন্ট ইত্যাদি। আর বাকি ৩০-৪০% মার্কের জন্যে ট্রাডিশনাল এক্সাম পদ্ধতি ব‍্যবহার করা যেতে পারে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওপেন ও ন‍্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার নিয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করা যেতে পারে। এর ফলে দেশব্যাপী তাদের বিশাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কাজে লাগিয়ে সত‍্যিকারের ব্লেন্ডেড অনলাইন এডুকেশন বিশেষ করে এসেসমেন্ট, কাউন্সেলিং, ভিডিও স্ট্রিমিং সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

অনলাইন এডুকেশনের নিজস্ব কোনো সমস্যা নেই, যে প্রতিষ্টান এটি পরিচালনা করবে তার গ্রহণযোগ্যতা এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্থিতিশীল এলএমএস প্লাটফর্ম এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল থাকা অত্যাবশকীয়। দেশে প্রতি বছর যত শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, তাদের সবার জন‍্য নিরবচ্ছিন্ন কার্যকরী শিক্ষার ব‍্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে অনলাইন ডিজিটাল এডুকেশনের বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল এডুকেশন বাস্তবায়নে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিমালা নির্ধারনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন ডিজিটাল এডুকেশন প্লাটফর্মগুলো একসেস করতে নামমাত্র মূল‍্যে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া, লাইব্রেরি থেকে ডিভাইস লোন হিসাবে দেওয়া, শিক্ষকদের প্রোমোশনে অনলাইন ট্রেনিং সার্টিফিকেশন অন্তর্ভুক্ত করা, সক্ষমতা অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাথমিকভাবে কিছু কোর্স অনলাইনে পরিচালনা করতে অনুমতি দেওয়া, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্সটাকে গুরুত্ব দেওয়া, ইত্যাদি।

বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র দুটি ইউনিভার্সিটির অনলাইন এডুকেশন দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন আছে। যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার কর্মসূচি, তাই ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির মতো যারা অনেক বছর ধরে ডিজিটাল এডুকেশনে সাফল্য দেখিয়ে আসছে, তাদেরকে শর্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় অনুমতি দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। চলুন সবার জন‍্য ডিজিটাল এবং কার্যকরী এডুকেশন নিশ্চিত করি - তখন আপনাকে আর চাকরি খুঁজতে হবেনা, চাকরিই আপনাকে খুঁজবে।

লেখক: ডিজিটাল এডুকেশন এক্সপার্ট এবং পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ