২৪ জুন ২০২১, ২১:৪৪

সলিমুল্লাহ খানের ‘দার্শনিক’ অভিধা

সাহিত্য সমালোচক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান  © ফাইল ফটো

জার্মানির ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে সমাজতাত্ত্বিক, সাহিত্য সমালোচক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং শিক্ষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের একটি সাক্ষাৎকার গত ১১ জুন প্রচারিত হয়েছে। ইউটিউবভিত্তিক ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের কয়েক দিন আগে ডয়েচে ভেলে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের এই বহুমাত্রিক গুণে গুনান্বিত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানকে ‘শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানের দিনও ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান বিশিষ্ট সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন অধ্যাপক খানকে ‘শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন।

অধ্যাপক খানের ‘দার্শনিক’ পরিচয় নিয়ে ডয়েচে ভেলের ঘোষণা আসার পর থেকে দেশে বিদেশে খ্যাত অখ্যাত ব্যক্তিবর্গ তাঁর দার্শনিক পরিচয় নিয়ে আপত্তি তোলেন। তাদের অনেকাংশের মতে, দার্শনিক হতে হলে আগে দর্শনের ছাত্র হয়ে দর্শন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করে অতঃপর শিক্ষকের ভূমিকায় নামতে হয়। মানে দর্শনের ছাত্র হলেই শিক্ষক হওয়া যায় অথবা দার্শনিক অভিধা তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন বিদ্যা অর্জন করেছেন।

এই ধারা মতে সলিমুল্লাহ খান দার্শনিক নন। ব্যাপারটি এমন দাঁড়াচ্ছে যে, এই গোষ্ঠীর মতে এসএম সুলতানও চিত্র শিল্পী হবেন না। কেননা এসএম সুলতানের চিত্র শিল্পীর হবার কোন প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র সংগ্রহ করতে পারেননি; যেহেতু তিনি ঢাকা আর্টস কলেজে পড়েন নি। শুনেছি সেই জন্য সুলতান ঢাকা আর্টস কলেজের শিক্ষকও হতে পারেননি।

উক্ত অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের অনুসন্ধানীমূলক প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রাক্কালে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান তাঁর নামের আগে বা পরে কোন পদবী ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছেন। সাথে বলেছেন, আসল নাম বাদ দিয়ে অন্য পরিচয় যুক্ত করলে মানুষের মূল নামের তাৎপর্য হারায়। স্বভাবসূলভ বিনয় দেখিয়ে তিনি পুরো আলোচনায় ব্যক্তি সলিমুল্লাহ খানকে সামনে রেখে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন; তাঁর নামের আগে বা পরে কি যুক্ত হবে কি যুক্ত হবে না- এইসব আলোচনাকে গুরুত্ব দেননি।

সাধারণভাবে, দার্শনিক কে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে দর্শন কি আগে জানা জরুরি। একই সাথে দর্শনের কার্যাবলি কি কি সে বিষয়েও আলোকপাক করা দরকার। প্রাচীন গ্রীসে দর্শন বলে যে শব্দটি পরিচিত পেয়েছে তার অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘জ্ঞানের জন্য ভালোবাসা’। যিনি ‘ভালোবাসার সহিত জ্ঞান’ চর্চা করেন তিনিই দার্শনিক। দর্শন বা দার্শনিকের কাজ কি এই নিয়ে আমাদের প্রত্যকের নিজস্ব এবং স্বাভাবিক বোঝাপড়া আছে। সেই বিবেচনায় কে দর্শন পড়েছে বা পড়েনি; অথবা কে দার্শনিক অভিধা পাবার যোগ্য কে যোগ্য নয় সেটি খুব গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন নয়।

একই সাথে এটিও গুরুত্বপূর্ন নয় যে, যিনি দর্শন চর্চা করেন তাকে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শন অধ্যয়ন করেই দার্শনিক হতে হবে। আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শন অধ্যয়ন করলেই দার্শনিক হয়ে যাওয়া যায় তার নজিরও খুব বেশি নেই। ফলে দর্শন চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কে দর্শন চর্চা করবে, কে করবে না সেটি কোন ব্যক্তির দর্শনের প্রতি ভালবাসা এবং রুচির উপর নির্ভর করে। প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন শিক্ষা থেকে সনদ লাভের শর্ত পূরণ করেই যদি দার্শনিক হওয়া যায়, তাহলে যে ব্যক্তি দার্শনিক হবেন তাকে আজীবনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে সেটি শিক্ষা হবে না শিক্ষা নামের বন্দিদশা সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। 

David Stewart এবং  H. Gene Blocker নামের দুজন লেখক ১৯৮৭ সনে Fundamental of Philosophy (second edition) শিরোনামের বইয়ের প্রথম অংশের আলোচনায় বলেছেন, একজন দার্শনিকের কাজ হচ্ছে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক বিষয়ে জটিল চিন্তামূলক প্রশ্ন এবং সেই প্রশ্নসমূহের জবাবের প্রতিফলন ঘটানো। সেই বিষয়টি হতে পারে পদার্থবিদ্যা, মনোবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি। সাথে তারা আরো উল্লেখ করেছেন, একজন দার্শনিকের কাজ হতে পারে সমালোচনামূলক অথবা গঠনমূলক আলোচনার জন্ম দেয়া।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই বইয়ের লেখকদ্বয়কে দার্শনিক আর কে দার্শনিক নন এই বিষয়ে দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে অথবা দার্শনিক হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান লাগবে কিনা, এই আলোচনা সামনে আনার প্রয়োজন বোধ করেননি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলেন বলে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে বসে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন বলে তাঁর দর্শন পড়া হয়নি- এই তথ্য আমাদের দিল কে? আমরা কি ধরেই নিচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৩/৪ বছরের দর্শনে স্নাতক সম্পন্ন না করলে জীবনের অন্য কোন পর্যায়ে দর্শন পড়া যাবে না? অথবা আমরা কি এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করছি যে, প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র ছাড়া কারোর পক্ষে দর্শনের শিক্ষক হওয়াও সম্ভব না?

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান নিজেকে দার্শনিক পরিচয়ে পরিচিত করতে চান না, এটা তাঁর স্বভাবসূলভ বিনয়। এমনকি ‘অধ্যাপক’ হিসেবে তাঁকে ডাকতে খালেদ মুহিউদ্দীনের অনুষ্ঠানে বারণ করেছেন। কিন্তু দার্শনিকেরা যে সব কাজ করে থাকেন তার কোন কাজটি তিনি করছেন না বলে আপনাদের মনে হয়? এই প্রশ্নটি আপনাদের করতে চাই।

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের অনেক দোষ আছে। তাঁর প্রথম দোষ হচ্ছে, তিনি জ্ঞানের জন্য ভালোবাসাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। সত্যের জন্য তিনি লড়াই করতে ভালবাসেন। অন্য সকল বুদ্ধিজীবী যখন পদের জন্য, ক্ষমতার জন্য লালায়িত, তিনি তখন নীলক্ষেতের পুরাতন বইয়ের দোকানে শপিং করতে যান। ফিরে আসেন কার্ল মার্কস, জ্যাক লাকান, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, শার্ল বোদলেয়ার, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো, ফ্রানৎস ফানোঁ, লেভি স্ত্রস, এডওয়ার্ড সাইদ, তালাল আসাদ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে। কাজ করেন অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে। ফলে, বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও পড়াশোনা করেন ফেঞ্চ, ফিনিশ, গ্রীক, আরবি, ফার্সি ভাষায়।

বছরের পর বছর ধরে ইউল্যাবের শ্রেণীকক্ষ ব্যবহার করে বিশ্বের নামিদামি দার্শনিকদের কাজ নিয়ে সেমিনার করেন। নানান বয়সের মানুষের জন্য সেই সব সেমিনার উন্মুক্ত করে রাখেন। মজার বিষয় হচ্ছে,  সদা বিনয়ী, আগাগোড়া সদালাপী এবং পরোপকারী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানকে আপনারা দার্শনিক বানাতে চাইলেই যেমন পারবেন না; ঠিক তেমনি আপনার আমাদের দেয়া নামসর্বস্ব উপাধির জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

সাথে এও বলে রাখা প্রয়োজন, ডয়েচে ভেলে বা খালেদ মুহিউদ্দীনের দেয়া দার্শনিক অভিধার জন্য অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান অপেক্ষায় থাকেন না। সুতরাং এই অভিধা কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে আপনাদের এতো মাতামাতি সেই কর্মকাণ্ড পণ্ডশ্রম বৈ অন্য কিছু কিনা ভেবে দেখা যায়।  

লেখক: পিএইচডি গবেষক, হাঙ্গেরির কর্ভিনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট এবং শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।