করোনায় শিক্ষার্থীদের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চাই
শিক্ষাব্যবস্থা কাঁদছে মহা দুর্যোগ করোনার কাছে আত্মসমর্পণ করে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অপরদিকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে ঝরে যাচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সিদ্ধান্ত একাধিকবার নেওয়া হয়েছিল। তবে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কারনে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে বিকল্প কী, তত দিন কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, সরাসরি পাঠদান ও পরীক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে মন্ত্রণালয় নিয়মিত বিরতিতে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর খবর জানাচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায়, তাঁরা আশাহত হচ্ছেন। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বে বেশি দিন স্কুল বন্ধ থাকা ১৪টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
আমাদের দেশের শিক্ষাবিদেরা ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরামর্শ দিলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই মতামতকে উপেক্ষা করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই তারিখের পর তারিখ দিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ বন্ধের ফলে উচ্চশিক্ষায় সেশনজট বাড়ছে। রাজপথে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে আন্দোলন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জনসংখ্যার বড় অংশকে গণটিকাদানের আওতায় না আনতে পারা পর্যন্ত করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সেটার জন্য এক থেকে দুই বছর বা তার বেশি সময়ও লাগতে পারে।
দেশে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার প্রভাব বহুমাত্রিক। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি শিক্ষাবর্ষের প্রায় পুরোটাই হারিয়ে গেছে। আরও একটি শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকের মতো চলে গেছে।
শিক্ষাজীবন থেকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। আমাদের সহপাঠীরা পড়াশোনায় ফিরবে না।কারন তাদের কেউ কেউ শিশুশ্রমে নিয়োজিত হয়েছে। কেউ কেউ বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। শুধু পড়াশোনার ক্ষতি নয়, ঘরবন্দী শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকেই মুঠোফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
করোনার মধ্যে শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পড়াশোনা করছে।কিন্তু গ্রামের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার সংসদ টিভি ও রেডিওতে রেকর্ড করা ক্লাস প্রচার করছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারা বা শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে।
দেশের টিকার জন্য সম্প্রতি ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ লাখ ৩ হাজার শিক্ষার্থীর তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মোট ২২০টি আবাসিক হল রয়েছে। এগুলোতে আবাসিক শিক্ষার্থী প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ১৫ হাজার ৫২৪ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বড় সরকারি সাতটি কলেজ সহ সারাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কবে টিকার আওতায় আনা হবে বিষয়টি পরিস্কার নয়।
করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে তা মেনে নিয়েই মানুষকে জীবনযাপন করতে হবে। তাই অনির্দিষ্ট সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কীভাবে সচল করা যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিয়ে প্রথমে এলাকাভিত্তিক এবং শ্রেণিভিত্তিক ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বড়ই চ্যালেঞ্জিং। আর এই চ্যালেঞ্জকে বাস্তবতায় নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সমাধান করতে হবে।
তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে এগিয়ে নেব। কীভাবে, আমরা কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে শিক্ষাকে এগিয়ে নেব। কেবল মাত্র খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে সব দায়িত্ব শেষ তা হতে পারে না। নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শিক্ষাটুকু আত্মস্থ করব।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জয়পুরহাট সরকারি কলেজে।
আরও দেখুন: