শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কেমন বাজেট পেলাম

রিফাত আমিন রিয়ন
রিফাত আমিন রিয়ন  © ফাইল ছবি

মহামারীর মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও তা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ‘যথেষ্ট নয়’। এবার শিক্ষা ও প্রযুক্তি বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধনে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১৭২০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দের অংক দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ১৫.৭ শতাংশের মত, যা গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৫.১ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ, মোট বাজেটের অনুপাতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি।  

এদিকে করোনাভাইরাস যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, সেজন্য স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। গেল অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে এবার ব্যয় বাড়ল ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের স্বাস্থ্য বরাদ্দের আকার ছিল মূল বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ, এবার তা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।

গেল অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। পরে সংশোধনে তা বেড়ে ৩১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা হয়। জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য গেল বাজেটেও ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছিলেন। এবার বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ‘মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে’ ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। মূল বরাদ্দের হিসাবে তার এবারের স্বাস্থ্য বাজেটে টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৪ শতাংশ।

এবার প্রথমে শিক্ষাখাতে নজর দেওয়া যাক- শিক্ষাখাত নিয়ে দেশের সকল মানুষ চিন্তিত। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেশকিছু দিন থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানিয়ে লাগাতার আন্দোলন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।

আন্দোলন থেকে বিভিন্ন দাবিও জানানো হচ্ছে। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াসহ সকল শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার একটি রোড ম্যাপ ঘোষনা করা।

করোনার এই মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এমনটাই মনে করছে শিক্ষার্থীরা। আবার অনেকে মনে করছে জীবন বাঁচলে অনেক শিক্ষা গ্রহন করা সম্ভব তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধই থাকুক। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর দাবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার থেকে বন্ধ রাখার বেশি ম্যাসেজ পাচ্ছেন তিনি।  

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে পর্যায়ক্রমে আগামী ১৩ জুন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুতই চালুর কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা আবারো বাড়তে থাকার ফলে হয়তো এবারেরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ পেছাতে পারে। এদিকে করোনার ভ্যাকসিন না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না এমনটাই জানা যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে।

গেল অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধনে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। এবার শিক্ষা ও প্রযুক্তি বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দের অংক দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ১৫.৭ শতাংশের মত, যা গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৫.১ শতাংশ ছিল।

করোনার মহামারীতে শিক্ষাখাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া জরুরি কারণ, এসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে অনেক শিক্ষার্থীর বাল্য বিয়ে এবং শিশুরা শিশু শ্রমে জরিয়ে ফেলে শিক্ষা জীবনকে নষ্ট করছে। এসময় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করতে তাদের জন্য রাখতে হবে পর্যাপ্ত প্রণোদনা। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে অনলাইন ভিত্তিক সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে অর্থের অভাবে অনলাইন ক্লাস করার ডিভাইস না থাকায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তাদের জন্যও আলাদা করে দেওয়া উচিৎ অর্থ বরাদ্দ।

শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নানান কর্মসূচিও পালন করে। তাদের সাথে একমত প্রকাশ করে অন্তত করোনাকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ও দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য শিক্ষাখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। এদিকে প্রস্তাবিত অর্থবাজেটে  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মহল এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। তাই শিক্ষাকে কোন পন্য না বানিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপ করা থেকে সরকারকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।

এবারে আসা যাক স্বাস্থ্যখাতের দিকে, “গত বছর স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি, সংশোধিত বাজেট দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকায়। তার মানে যেটা বেড়েছে তাতে বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম হবে, সেটা ইনফ্লেশনেই চলে যাবে। যদি অন্যভাবে চিন্তা করি, বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশও হয় নাই।” এমন মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান এবং বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।

আসলে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই দেশে অনেক এগিয়ে যাবে স্বাস্থ্যখাত। লক্ষ করলে দেখা যাবে দেশে পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই, পর্যাপ্ত রোগীর বেড নেই, আবার নেই ডাক্তার। এসব সমস্যা নিয়ে চলছে দেশের জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। আবার সেসব হাসপাতালে রোগীকে সেবা দিতে গাফিলতিরও খবর উঠে আসে গণমাধ্যমে।

আমরা করোনার এই মহামারীতে গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি দেশের অবস্থা ও সংকট। এসকল সংকট কাটিয়ে উঠতে পারার এইটাই সময় তাই স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়া উচিৎ ছিলো। আবার দেখবেন অনেক জেলাতে আইসিইউ নেই, নেই কোন ভেন্টিলেটর। দেশে করোনার এই মহামারীতে অনেক রোগী চিকিৎসার অভাবেও মারা গেছে। প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এরপর সেসব সমস্যা নিয়ে কাজ করলেই স্বাস্থ্যখাতকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব যার জন্য চাই পর্যাপ্ত বাজেট। 

এবারে নতুন অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জন্য ২৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে বেতনভাতা ও অন্যান্য খাতে, ১৩ হাজার কোটি রাখা হয়েছে উন্নয়ন খাতে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ ৬ হাজার ৮১৭ কোটি টাকার মধ্যে বেতনভাতা ও অন্যান্য খাতে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা যাবে। ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে উন্নয়ন বরাদ্দ।

এবার টিকার জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ না রাখলেও নতুন অর্থবছরে টিকা কেনার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়ার লক্ষ্য ঋণচুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং এআইআইবি থেকে টিকা কেনার জন্য সহায়তা পাওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী।

আরও দেখুন: শিক্ষায় ভ্যাট কাম্য নয়

 

লেখক:

সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ। 


সর্বশেষ সংবাদ