শিক্ষায় ভ্যাট কাম্য নয়
গণতান্ত্রিক একটি দেশে শিক্ষা নাগরিকদের অধিকার। যেমনটা তার অধিকার আছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা সেবা পাওয়ার। অথচ আমাদের সরকারগুলো নাগরিকদের সেই অধিকার রক্ষায় সব সময়েই স্বেচ্ছাচারিতা দেখি এসেছে।
বিএনপি জোট সরকারের আমলেও শিক্ষা খাতে ভ্যাট আরোপিত হয়েছিল। নানান সমালোচনার মুখে যা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আওয়ামীলীগ সরকারও ২০১৫ সালের পরে নতুন করে আবার ২১-২২ অর্থ বছরে বেসরকারি শিক্ষায় ১৫% ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবনা তুলেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রম বৃদ্ধিসাধান এবং জণগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধণ, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়: (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।’
পড়ুন: বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৫% ভ্যাট দিতে হবে
VAT এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Value Added Tax বা মূল্য সংযোজন কর। মূল্য সংযোজন কর সেখানেই আরোপিত হবে যেখানে মুফার উদ্দেশ্যে ব্যবসা থাকবে। শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার গুলোর অন্যতম। শিক্ষা কোন পন্য নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইন ২০১০-এ স্পষ্ট বলা আছে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অমুনফাভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাহলে শিক্ষার উপরে কোন আইনে ভ্যাট আরোপ করা হবে!
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত আসন না থাকা এবং কলেজগুলোতে অতিরিক্ত সেশনজট হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। সুতরাং এখানে স্বচ্ছল উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাই ভর্তি হয় এমনটা না। বরং মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীও এখানে পড়ে। ধারদেনা করে সন্তানদের এখানে পড়ানোর একটাই উদ্দেশ্য, ভালো একটা চাকরি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাট পরিশোধ করলেও অর্থ মূলত শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করে নেয়া হবে। কারণ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে টিউশন ফি। টিউশন ফি নির্ধারণ না থাকায় আগের চেয়ে বেশি টিউশন ফি আদায়ের সম্ভাবনাও থেকে যায়। অথবা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে কম সেবা প্রদান করবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীদের একটা বিপুল অংশ। শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের উপরেই করের বোঝা এসে পরবে। পরিণামে উচ্চ শিক্ষায় ঝরে যাবে অনেক সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী।
ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে পূর্ব থেকেই ভ্যাটের বোঝা বহাল আছে। করোনা পরবর্তী জরুরি ছিল শিক্ষার্থীদের বেতন ও ভর্তি ব্যয় কমানো। রাজস্ব বাড়ানোর অযুহাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে ভ্যাটের প্রস্তাবনা আইন বহির্ভূত দুচোখা নীতি, বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক এবং অমানবিক। জটিলতাপূর্ণ সময়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরে ভ্যাট আরোপ কি খুবই অপরিহার্য ছিল? বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুৎপাদনশীল খাতের বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের আরেকটু সুবিধা দেওয়া কি যেত না!
ইউজিসির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাষ্ট্র শিক্ষা খাতে আর বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয় এবং ২০২৬ সাল নাগাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নিজস্ব অর্থায়নে চলতে হবে। অর্থ দাড়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহনকারীকেই শিক্ষা ব্যয় বহন করতে হবে। শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে না।
মোদ্দাকথা উচ্চশিক্ষা পরিণত হবে সার্টিফিকেট বিক্রয়কেন্দ্রতে। শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর ঘটতে যাচ্ছে চোখের অগোচরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে ইউজিসির সুপারিশ কলে পড়বেন না এমনটা ভাবারও অবকাশ নেই।
করোনাকালীন এই সময়ে সরকারের উচিত ছিল ছাত্রদের জন্য শিক্ষায় প্রণোদনামূলক সুবিধা প্রদান করা, বিনা সুদে শিক্ষা ঋণ প্রদান করার এবং পার্ট টাইম কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা বহির্বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মত। শিক্ষা সূচক ধরে রেখে ২০২৭ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর ঘটতে এর বিকল্প নেই। শিক্ষায় উৎসাহিত করতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ট্যাক্সও ছাড় দেয়া হয়। এমতাবস্থায় ভুলনীতি নিয়ে উল্টো পথে হাটছে কেন বাংলাদেশ! শিক্ষা থেকে আয়ের চিন্তাই কেন করতে হবে রাষ্ট্রকে? শিক্ষা কি আয়ের মাধ্যম?
শিক্ষায় ভ্যাট কোন বিবেকবান জাতির কাম্য নয়। সরকারের কাছে প্রত্যাশা বেসরকারি শিক্ষার উপরে প্রস্তাবিত ভ্যাট পুনর্বিবেচনা করে শিক্ষায় বৈষম্যমূলক পরিবেশ সৃষ্টি না করতে এবং রাষ্ট্রের সংবিধানের উপর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে যথাযথ মেনে চলতে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক