টানা পার্টি
কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণী, সোবহানবাগ মোড়— এসব জায়গায় একটা গ্রুপ থাকে যাদের চলতি নাম “টানা পার্টি”। এসব পার্টির লোক রাস্তায় ঘুরঘুর করে। যখন বাস এসে জ্যামে থামে তখন টার্গেট ফিক্স করে। টার্গেট থাকে তারা যারা বাসে/গাড়িতে খোলা জানালার পাশে বসা, কানে ফোন বা হাতে ফোন নিয়ে গভীর মনোযোগে ফেসবুকিং করতেছে।
তারপর যেই জ্যাম ছুটে গাড়ি ধীরে চলতে শুরু করে সেই চলন্ত বাস/গাড়ি থেকে যাত্রীর কানের মোবাইল ছোঁ মেরে নেয়। আমার অভিজ্ঞ চোখ এখন এসব পথে যাওয়ার সময় লোক দেখলেই চিনে ফেলে কোনটা টানা পার্টি আর কোনটা না। ওই এলাকার পুলিশের এগুলি অজানা থাকার কোনো কারণ নাই।
মোবাইল নিয়ে আমার কপাল খুব ভালো। কখনো হারায় নাই, চুরি হয় নাই বা টানা খায় নাই। এমন অনেকবার হইছে আমি ভুলে কোনোখানে ফোন রেখে চলে আসছি, সেইখানে আর কেউ ফোন করছে তখন তাকে জানায়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে ফোন ফেরত দেয়া হইছে।
তবে আমার প্রথম মোবাইল, অ্যান্টেনাওয়ালা ম্যাক্সন-২০ একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছিল। তখন কলেজে পড়ি। আর ওইদিন একটানা সন্ধ্যা মোবাইলের শোকে শুয়ে ছিলাম। এছাড়া আর কোনো মোবাইলবিয়োগে জীবনে ঘটেনি।
তবে ঈদের দিন সাজগোজ করে বেড়াতে যাওয়ার সময় পান্থপথ মোড়ের আরেকটু পরে স্কয়ার হাসপাতালের সামনে এক মোটরসাইকেলে চড়ে দুই যুবক আমার হাতের ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। আমি দেই পাল্টা টান। কারণ বহুত দূর থেকেই আমি তাদের ধান্দা বুঝে গেছিলাম।
গলি থেকে বের হওয়ার সময় মোটরসাইকেল আরোহী দুজন যে ফাঁকা রাস্তায় আমার রিকশাকে টার্গেট করছিল সেটা আমি খেয়াল করছিলাম। তাই ওরা যখন রিকশার পাশে এসে আমার ব্যাগ টানতে শুরু করল, আমি হেসে বললাম— নিতে পারলে নে। ‘নিতে পারে নাই’।
আরেকটা ছিনতাই স্পট ছিল পরীবাগ। ছিল বললাম কারণ এখন আর ওখানে অন্ধকার নাই। লেড লাইট সন্ধ্যার অনেক আগে থেকেই জ্বলে। ২০১৩ সালে পরীবাগে এমন এক পার্টির খপ্পরেও আমি পড়ছিলাম। সেসময়ের লেখাটা এইটা—
ছিনতাই (জুন ২৩, ২০১৩)
পকেটে নাই টাকা, তবু থাকতে হবে ঢাকা। এদিকে আফজাল ভাই বাসা থেকে টাকা আনছে। তাই টাকা আনতে গেলাম আজিজ মার্কেট। আমার বাসা থেকে আজিজে লাফ দিয়ে যাওয়া যায়। তাই আমি এক হাতে আমার শূণ্য মানিব্যাগ আরেক হাতে ফোন নিয়ে বাসা থেকে রওনা হলাম।
কারেন্ট নাই। চারিদিক ঠাণ্ডা। বৃষ্টি হবে হবে ভাব চারিদিকে। আমি এমনিতেই হনহন করে হাঁটি। একটু অন্ধকার মতন একটা জায়গায় আসতেই গাছের ছায়ার মধ্য থেকে দুইটা লোক আমাকে ডাক দিল- এই যে আপা একটু কথা বলা যাবে?
আমার মস্তিস্ক এরপর চল্লিশ সেকেন্ড সময় নিল। দশ সেকেন্ড- আফজাল ভাইকে ঠিক এ জায়গাতেই এভাবেই ছিনতাইকারী ধরছিল। দশ সেকেন্ড-ওদের একজনের দুই হাতই পকেটে ঢুকানো। দশ সেকেন্ড- আমার মানিব্যাগে কোনো টাকা নাই তাতে কী, সেইটার দামই সাতশ টাকা। তারপর আমার মোবাইল!
দশ সেকেন্ড- একবার ডানে একবার বামে তাকালাম। কোথাও কেউ নাই। এরপর আস্তে করে দুকদম পেছনে ফিরে দিলাম বাসার দিকে ভোঁ দৌড়। এক দৌড়ে বাসার সামনে গিয়ে থামলাম। এরপরেই আমার মনে হইল- হায় হায় ভীতুর ডিমের মতন এইটা আমি কী করলাম! আমি না জুডো কারাতে জানি! [ফেসবুক থেকে সংগৃহীত]
লেখক: সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা