শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলুন, নাহলে প্রতিবন্ধী প্রজন্ম পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করুন

কাবিল সাদি
কাবিল সাদি  © টিডিসি ফটো

বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াল থাবা চীনের উহান অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের আনাচেকানাচে প্রায় সব এলাকায়। করোনার ছোবলে দিনের পর দিন আক্রান্ত হয়েছে মানুষের জীবনের পাশাপাশি শিক্ষা, শিল্প, অর্থ, ব্যবসাসহ মানুষের সার্বিক জীবিকার অবলম্বনটুকুও। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোও বাধ্য হয়েছে দিনের পর দিন লকডাউন দিয়ে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। কিন্তু বিশ্বের কোন মহামারী সংকটই অল্প সময়ের জন্য আসে না বরং তার প্রভাব বহন করতে হয় দিনের পর দিন। এমন কি কয়েক বছর তার প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয় আক্রান্ত এলাকার সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্প, সমাজ এবং আর্থিক সংশ্লিষ্ট বিষয়কে।

কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী যে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর আভাস মতে তা কোনভাবেই অল্প সময়ে নিস্তার দিবে না।তাই এই করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিকল্প চিন্তা করার পক্ষেই জোর দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ভ্যাক্সিন নেয়ার মধ্য দিয়েই আমরা যে নিরাপদ হচ্ছি তা নয়, তবে এই ভ্যাক্সিনেশনের সাথে সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সাথেই আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। সামাজিক নানা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমেই করোনাকালীন বিশ্বে নিজেকে অভিযোজিত করে নিতে হবে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই বছরের পর বছর ধরে এভাবে লকডাউনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনকে আবদ্ধ করে সামনে আগাতে পারবে না। উপরন্তু মানুষের জীবিকার পথ রুদ্ধ হলে দারিদ্র্য, সন্ত্রাসবাদ, আর্থিক অভাব অনটন, পারিবারিক ভাঙন এবং মানসিক সমস্যাসহ অন্যান্য সামাজিক অবস্থা ভয়ানক আকার ধারণ করে নতুন মহামারী সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই বিকল্প কৌশল অবলম্বনের মধ্য দিয়েই এই মহামারী সংকটে টিকে থাকতে হবে।

যেকোনো ধরনের বৈশ্বিক মহামারীতে যে সকল সংকট তৈরি হয় তা কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সমান নয় বরং অঞ্চল ভেদে আর্থিক সচ্ছলতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব লক্ষ করা যায়। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সেটা আবারও প্রমাণ করেছে। ইউরোপ আমেরিকার মত পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো যেভাবে এই সংকট মোকাবেলা করে চলেছে তা কিন্তু এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলগুলো পারেনি। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি যেভাবে নাগরিকদের সুচিকিৎসা, আবাসন, অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার সংকটসহ- এমন কি সৎকার সংকটে পড়েছে তা কিন্তু পশ্চিমা উন্নত দেশে এতোটা দেখা দেয়নি। এমন কি লকডাউন পরিস্থিতিতে এসব দেশ যেভাবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, ভাতা প্রদান ও খাদ্য সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে তা এই উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে কল্পনাও করা যাবে না। বিশেষত বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকার পরেও লকডাউনে মানুষের বেকারত্ব, খাদ্য সংকট, আবাসন সংকট, আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের হিড়িক, ত্রাণ সংকট ও জনপ্রতিনিধিদের সেই ত্রাণ আত্মসাতের ঘটনার সাথে স্বাস্থ্য সেবায় ভয়ানক দুর্নীতিই প্রমাণ করে সব দেশে সব পদ্ধতি কার্যকর নয়। তাই বিকল্প আমাদের ভাবতেই হবে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারীর শুরুতেই বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতা ও গুরুত্বের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ২০২০ সালের মার্চের শেষের দিকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দেয়। জরুরি সেবায় নিয়োজিত বিশেষ বিবেচনায় লকডাউন আওতার বাইরে রাখা হয় শুধু চিকিৎসা, ব্যাংকিং ও আইনশৃঙ্খলা খাত। বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় শপিং মল,পরিবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন কি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোও। দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শ্রেণী, পরিবহন মালিক, গার্মেন্টস মালিকদের ক্ষতি পূরণে তাদের স্বার্থে এবং কিছুটা মানবিক কারণেই আন্দোলনের মুখে এক প্রকার বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নেয়ার শর্তারোপ করে খুলে দেয়া হয় শপিং মলসহ সকল দোকান পাট ও হাট-বাজার। ধর্মীয় বিষয় বিবেচনায় ঢিলেঢালা ভাবে সক্রিয় হতে শুরু করেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয়। লকডাউন উপেক্ষা করে ইদের ঘরেফেরা মানুষের ঢলে বাধ্য হয়ে খুলে দেয়া হয় ফেরি পারাপার এবং বর্তমানে সারাদেশেই চালু হয়েছে পরিবহন সেবা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এসবের মধ্যে কঠোর লকডাউনে গত দেড় বছরে আবদ্ধ আছে শুধুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কয়েক দফা পিছিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার তারিখ। ইতোমধ্যেই উচ্চমাধ্যমিকে অটো প্রমোশন দেয়া হয়েছে যারা গত এক বছরে শুধু ফলাফল পেয়েই আত্মতৃপ্তিতে আছেন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা। এখনো কেউ উচ্চতরে ভর্তির সুযোগ পাননি শুধু মেডিকেলের ভর্তি প্রার্থীরা একটি নির্বাচনী পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন যাদের ভর্তি কার্যক্রমও প্রায় স্থগিত। এই দীর্ঘ সময়ে লকডাউনে বন্ধ সকল উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ফলে দেড় বছর ধরে অটো সেশনজটে পড়ে আছেন তারা। শুধু তাই নয় যারা গ্রাজুয়েশন শেষ করে বের হয়েছিলেন তারাও দিতে পারেননি কোন নিয়োগ পরীক্ষা দুয়েকটা ব্যতিক্রমী ছাড়া। বয়স যাদের শেষ তারাও হতাশায় শেষ করছেন তাদের সীমিত বাকী থাকা বয়স টুকুও। হতাশায় নিমগ্ন হচ্ছেন চাকুরী বঞ্চিত বেকার প্রার্থীরা। তাদের বড় একটা অংশ ইতোমধ্যেই যোগ দিয়েছেন কৃষিসহ অন্যান্য উদ্দেশ্যহীন কর্মে শুধু পরিবারে টিকে থাকার যুদ্ধে। ভয়ানক হারে ছাত্রছাত্রী ও চাকুরী প্রার্থীদের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে হতাশার সাথে আত্মহত্যার প্রবণতা। এদিকে অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে বাচ্চাদের হাতে তুলে দেয়া স্মার্টফোনে এখন শোভা পাচ্ছে অনলাইন আসক্তি এবং স্কুল পড়ুয়া ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ভয়ানকভাবে ঝেঁকে বসেছে ফ্রি ফায়ার বা পাবজির মত ভয়ানক গেইমস খেলার প্রবণতা। দলবেঁধে সারাদিন এসব গেইমস খেলার মধ্য দিয়েই দিন পাড় করছেন উঠতি বয়সী একটি গেইমস আসক্ত প্রজন্ম। পড়াশোনা না থাকায় এসব কর্মকাণ্ডের বাধা দেয়াও মানছেন না তারা। ফলাফল সামাজিক অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে শিশুরা। সম্প্রতি গেইমস খেলার অর্থ জোগাতে ব্যর্থ হওয়ায় এক স্কুল পড়ুয়া শিশু আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামেও পৌঁছে গেছে জুয়া খেলার প্রবণতা। কোন ভাবেই তারা অভিভাবকদের কথার তোয়াক্কা করছেন না। তাদের স্কুল বা পড়াশোনার সময় পাড় করছেন এসব গেইমসে আসক্ত হয়ে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সমস্যা এখানেই থেমে নেই। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মচারীরা নির্বাহ করছেন এক মানবেতর জীবন। চাকরী, কোচিং এমন কি টিউশনি করে চলা ছেলেটাও এখন পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়েছে।শিক্ষার পেশা পরিবর্তন করে অনেক শিক্ষক বা শিক্ষিত যুবকেরা দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে কোন রকমে দিন পাড় করছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায়।

অথচ মজার বিষয় হলো যে, স্বাস্থ্যবিধির অজুহাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অথচ সেই শিক্ষার্থীরাই দলবেঁধে পাবজি গেইমস খেলছেন কোন স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই। করোনা আক্রান্ত ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক শিক্ষকও ভীড় ঠেলে প্রতিদিন বাজার করছেন। স্কুলের মাঠে ছোট বাচ্চার অপেক্ষায় থাকা মায়েরা শপিং মলে যাচ্ছেন সেই বাচ্চাদের নিয়ে। কোথাও কিছু দাঁড়িয়ে নেই শুধু দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দেড় বছর ঘরে বসে থাকা ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায় একটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী গেইমস আসক্ত শিশু প্রজন্ম এবং হতাশা গ্রস্ত চাকুরী প্রার্থী তরুণ প্রজন্ম। আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে জরাগ্রস্ত শিক্ষা দীক্ষাহীন একটি প্রতিবন্ধী নির্বাক সমাজের প্রতিচ্ছবি।

তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলবো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলুন নাহলে প্রতিবন্ধী প্রজন্ম পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করুন।

লেখক: নাট্যকার ও ব্যাংকার


সর্বশেষ সংবাদ