৩০ মে ২০২১, ২০:৫৩

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে বিপদ বাড়বে!

আগামী ১৩ জুন থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার কথা রয়েছে  © ফাইল ছবি

করোনা মহামারীতে গত ১৪ মাস ধরে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। শিক্ষা ব্যবস্থা বাধ্য হয়েই এক ধরনের অসহায়ত্বের ভেতর থেকে দিন পার করছে বলা যায়। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে শিক্ষার্থীরা হৈ-চৈ শুরু করেছিল, দাবির প্রেক্ষিতে একপর্যায়ে ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করে দিতে হয়।

ওই সময়ে আক্রান্তের হার ছিলো একেবারেই নিম্নের কোঠায়। অথচ বর্তমান সময়ে যখন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আক্রান্তের হার ভয়াবহ রকমের বাড়তেছে এবং ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে প্রবেশ করে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে দেবে সেই সময়টাতে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য সোচ্চার হয়েছেন। তারা আকুতি জানাচ্ছেন ক্যাম্পাসে ফেরার। ভাইরাসের বিপরীতে বাছবিচারহীন খামখেয়ালিপনা করলে কবর-শ্মশানের জায়গায় জুটবে না এটা স্পষ্ট।

দীর্ঘকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্কুল কলেজের ছেলেরা গেমসসহ নানান রকম জিনিসে আসক্ত হয়েছে। পড়াশোনা শিকায় তুলেছে কমপক্ষে ৭০% ছাত্র। গ্রামের অর্ধেকের বেশি ছাত্ররা হয়তো আর কখনোই স্কুল কলেজে ফিরতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাসগুলো অনলাইনে নেওয়ার কথা উঠলে শুরুতে ভালোই চলেছিল। গরীব অনেক ছাত্রদের মোবাইল-কম্পিউটার ছিল না, আবার গ্রামের দিকে নেটওয়ার্ক সমস্যাও ছিলো মারাত্মক।

পড়ুন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে প্রয়োজনে আবার বন্ধ করুন

ফলে একদিকে শহর এবং গ্রামের বৈষম্যের মাত্রাও চরমে ছুঁয়েছিল। বিপরীতে অর্থনৈতিক সমস্যার ভিতর থেকেই প্রথমদিকে ছাত্রদের গাছ তলায়, জঙ্গলে এবং উঁচু স্থানে উঠে প্রযুক্তির আওতায় ক্লাস করতে দেখা গেছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই শিক্ষার্থীরা যেমন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, ঠিক তেমনি আমাদের শিক্ষকেরাও শুরু থেকেই আগ্রহ দেখাননি। ক্লাসে সিগারেট ধরিয়েছেন এরকম খবরও আমরা পেয়েছি। গড়ে ১০০ জন শিক্ষার্থীর শুরুতে ৯৫-৯৯ জন উপস্থিতি থাকলেও, এখন উপস্থিত থাকছেন ৪০-৫০ জন। ছেলে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার যেখানে আশঙ্কাজনক!

শিক্ষার্থীরা বছরেরও বেশি সময় বাড়িতে মা-বাবার সাথে থাকছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী আসে গরীব পরিবারগুলো থেকে। তাদের পরিবারগুলোও তাকিয়ে থাকে ছেলে মেয়েরা পড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবে, একটু সুখের মুখ দেখবে। অনিশ্চয়তা হতাশায় পরিণত হয়ে পারিবারিক নাজুক অর্থনৈতিক চাপেও যে কোন উপায়ে ক্যাম্পাসে ফেরার চিন্তা করছেন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা। তাদের মাথায় চেপে বসেছে কোন কায়দায় পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে বের হতে পারলেই চাকরি।

কিন্তু তারা চিন্তা করছেন না করোনার আগে শিক্ষিত বেকার ছিলো ২৬ লক্ষ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাটাই হয়ে সেটা বেড়েছে বহুগুণে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্মসংস্থান করা থেকে বিরত আছে, সরকারি চাকরির নিয়োগের সার্কুলার স্থগিত এবং ইদানীং দুএকটা সার্কুলার হলেও দেখা গিয়েছে আগে যেখানে ১৫ জনের সার্কুলার হত সেখানে এখন ৫ জন নিচ্ছে! পরিণামে পাশ করে বের হলেই চাকরি মিলছে না সেটা তারা মোটেই চিন্তা করছেন না। সুতরাং এ স্থিতিশীল অবস্থায় হঠাৎ করে আরো নতুন কয়েক লক্ষ বেকার যোগ হয়ে হ য ব র ল অবস্থা সৃষ্টির সম্মুখীন।

বাংলাদেশকে বহু আগেই ডিজিটালাইজড ঘোষণা করা হয়েছে। পার্লামেন্টের অনেক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড হয়ে গেছে! তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এই হাল কেন? শিক্ষার্থীরা কেন ক্যাম্পাস খোলার দাবি করবে? আসলে একটা রাষ্ট্রে স্বেচ্ছাচারীতা কায়েম করতে শিক্ষা ব্যবস্থার মাজা ভেঙে দিতে হয়, করোনার কলে ফেলে আমাদেরও হয়েছে তাই।

ডিজিটালাইজড করতে এত এত হাজার কোটি টাকার বাজেট হাওয়া হয়ে গেল না তো! প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার দেখভাল যারা করবে শিক্ষা নিয়ে তাদের নূন্যতম আগ্রহ নাই। যদি আগ্রহ থাকবে তাহলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলতে পারেন না যে হল না খোলার শর্তে পরীক্ষা হতে পারে। হল না খুলে পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীরা যাবে কই? হল না খুলে পরীক্ষা নেয়ার অর্থ দাড়ায় ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে তোমরা মর বাঁচো তাদের কোন দায় দায়িত্ব থাকবে না।

জটিলতাপূর্ণ এই সময়ে জরুরি পদক্ষেপ হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। সকল শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তির আওতায় এনে নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস সচল রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই প্রথম থেকেই। ক্রিয়েটিভ প্রশ্নের মাধ্যমে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। অর্থাৎ মিনিমাম ক্লাস শেষ হলে পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা কমিটি ছাত্রদের জন্য প্রশ্ন তৈরি করে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে পরীক্ষা নেবেন।

নির্দিষ্ট সময়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন পাবে এবং নিজেরা পরীক্ষার খাতা তৈরি করে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে উত্তর লিখে সেটার পিডিএফ তৈরী করে জমা দেবে। শিক্ষক পিডিএফ খাতার মূল্যায়ন করবেন এবং ফল প্রকাশ হবে। ছাত্রকে তার ক্লাসের সময়ে গুরুত্ব দিতে হবে, সঠিকভাবে ক্লাস না করলে ইন্টারনাল মার্কস কাটা'র ব্যবস্থা করতে হবে।

শিক্ষকেরা অবহেলা করলে তাকেও আনতে হবে শাস্তির আওতায়। স্কুল কলেজের ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাসের পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা যুক্তিযুক্ত ছিল। চাকরির পরীক্ষাগুলোও যথাসম্ভব ক্রিয়েটিভ মূল্যায়নের মাধ্যমে অনলাইনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। উপর্যুপরি আহ্বান করে মূল্যায়নের মাধ্যমে সরকারি আওতায় এনে অর্থ সহযোগীতা দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে প্রবেশ করানো জরুরি যে সকল মানুষ চাকরি হারা হয়েছেন। সাথে সাথে করোনাকালীন সময়টা লুপ্ত বছর হিসেবে সমন্বয়(যারা চাকরিতে প্রবেশ করেননি) যথাযথ পদক্ষেপ। তাহলে চাকরীর বয়স নিয়ে হা-হুতাশেরও লাঘব ঘটবে।

প্রকৃতির বিপরীতে অবস্থান নিয়ে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য দাড়াচ্ছেন তারা আবেগে ভাসছেন অথবা রাজনৈতিক কারণে, বাস্তবতায় তলিয়ে দেখছেন খুব কম জনই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ছাত্রদের সমাগম কোন প্রকারেই এড়ানো সম্ভব হবে না। সব সেক্টর খুলে দিয়েছে অযুহাত দেখিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও একজন ছাত্রের মৃত্যুর দায় নেয়ার মত সৎ সাহস কারোই নেই।

জোড়াতালি দিয়ে চলা বাংলাদেশে অসচেতনতায় একবার বড় ধরনের ঢেউ শুরু হয়ে গেলে জীবনের সবকিছু ভেসে যাবে। জনগণ বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।

সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে আমরা জানতে চাই ঢাক ঢোল পেটানো দোয়েল ল্যাপটপ কোথায়? হোয়ার ইজ ডিজিটাল? দায় দায়িত্ব নিয়ে বাস্তবতায় চর্চা করতে সকলকে অনুরোধ। ভবিষ্যত প্রজন্ম টিকিয়ে রাখতে এখনই সময় উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার। নয়তো নিজেকে পরিবর্তন করে কার্বোনিফারস সময়কালের তেলাপোকা টিকে থাকবে আর সভ্যতা তলিয়ে যাবে!

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক