২৯ মে ২০২১, ১১:২১

উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা: অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রহসন নয় তো!

আপেল মাহমুদ, এমফিল গবেষক  © ফাইল ছবি

প্রকৃত শিক্ষা মানুষ কে বিনয়ী করে তুলে, অল্প বিস্তর জ্ঞান মানুষ কে অহংকারী ও হিংস্র করে তুলে। আঠারো শতকের শেষাংশে এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ মদদে উপমহাদেশে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রুপ বিস্তৃতি পায়। তৎকালীন শুরুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা অক্ষর-জ্ঞান কিংবা সার্টিফিকেট কেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ ছিলো না।

তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে জীবনের প্রকৃত স্বাদ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিল। দুই পা-ওয়ালা জীব থেকে মনুষ্য গোষ্ঠী রুপে গড়ার প্রত্যয়ে সচেষ্ট হয়েছিল। জ্ঞান গরিমায় অহংকারী না হয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়ার নিমিত্তে তাঁদের অন্তর্ধান ইতিহাস শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ঘণীভূত হয়েছিল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অন্তঃচক্ষু প্রস্ফুটিত হওয়ার মাধ্যমে। শিক্ষার প্রকৃত মহাত্মা তাঁরা অনুধাবন করতে পেরেছিল।

পাকিস্তান আমলে ৫২' র ভাষা আন্দোলন, ৬২' র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬' র ছয় দফা, ৬৯' র গণ অভ্যুত্থান সর্বোপরি ৭১' র মহান মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ইতিহাস সমাদৃত।

কিন্তু ৭১ পরবর্তী সময়ে শিক্ষা শব্দ টা ঠিক কতটুক আশীর্বাদিক তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। সার্টিফিকেট শিক্ষার প্রসার হয়তোবা যথেষ্ট হয়েছে, তাতে কি বাঙালির হাজার বছরের জ্ঞান মুক্তির প্রকৃত স্বাদ আমরা নিতে পেরেছি!

স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দুর্নীতির দিকে আঙ্গুল তুলেছিলেন। তিনি বাঁচতে পারেন নি। সেই শিক্ষা শব্দটার প্রকৃত মহাত্মা থেকে কতিপয় প্রেতাত্মার হাতেই তাকে জীবন দিতে হয়েছে। যার বিষবাষ্প আজও সমাজে স্পষ্ট লক্ষণীয়।

৭১ পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন আবশ্যক ছিলো। যা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আমরা একটা টেকসই এবং মানবিক শিক্ষা কাঠামো দাঁড় করাতে সমর্থ হইনি। এই অভিশাপ আমাদের ভোগ করতেই হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

প্রকৃত শিক্ষার অভাবহীনতা একবিংশ শতাব্দীর করোনা যুদ্ধ আরও বেশি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। করোনা মহামারী যুদ্ধেও একটা উচ্চ সার্টিফিকেটধারী শ্রেণি প্রতিনিয়ত করোনাকেও হাস্যরসের পর্যায়ে দাঁড় করেছে। পাহাড়সম দুর্নীতির মাধ্যমে সাধারণের, শিক্ষিত মানুষের প্রতি ঘৃণার তীর্যক বাণ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করেছে। আবারও প্রশ্ন উঠেছে প্রকৃত এবং মানুষ হওয়ার শিক্ষার মহাত্মা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, আজকের ও আগামীর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। শঙ্কা জেগেছে শিক্ষা ব্যবস্থার আশু ভবিষ্যত নিয়ে।

করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যে সকল সার্টিফিকেটধারী মস্তিষ্ক শূন্য অথর্বরা প্রতিনিয়ত দুর্নীতির মহোৎসবের মাধ্যমে আমার সোনার বাংলাকে হেয় প্রতিপন্ন করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তাদের প্রতি একরাশ ঘৃণা। তবে এতদস্বত্ত্বেও তারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ায় গলদটা আরও স্পষ্ট করে গেছে। আমাদের শোধরে নেওয়া উচিত এই মুহুর্তেই।

শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আমরা করোনার গত ১৫ মাসেও দৃশ্যমান করতে পারিনি। বরঞ্চ সমন্বয়হীনতার অভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা আরও পিছিয়েছে বহুগুণে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সারি সুদীর্ঘ হচ্ছে। কোন কোনও ক্ষেত্রে সেটা ২৫ শতাংশও ছুঁয়েছে।

আরও দেখুন: উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াতেই মারাত্মক গলদ

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও প্রায় হতাশ একটা প্রজন্ম আমাদের জন্য অভিশাপ হতে যাচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকেও আমরা সামগ্রিকভাবে সফল করে তুলতে পারিনি। গত ১৫ মাসেও মূল্যায়ন পদ্ধতির সুনির্দিষ্টকরণ সম্ভব হয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সমন্বয়হীনতার জন্য। যা সার্টিফিকেটধারী জনগোষ্ঠীর সমন্বয়হীনতার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত ও আশঙ্কার। যেখানে অনলাইন ক্লাসে ৫০ শতাংশের মতোও সফলতা দেখাতে পারিনি, সেখানে অনলাইন মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেকের জন্য প্রহসন হয়ে দাঁড়াবে নিশ্চয়ই। যা নিশ্চিতভাবেই সার্টিফিকেট বিতরণ বৈ কিছুই হবে না। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাও নতুন করে প্রহসনের পর্যায়ে দাঁড়াবে।

করোনা উদ্ভূত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যদি প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান ও পরীক্ষা পদ্ধতি সামগ্রিকভাবে চালু নাও করা যায়, তবে অন্তত যেনো পরীক্ষাগুলো বিভিন্ন বর্ষকে আলাদাভাবে রোস্টিং/ শিফ্টিং করে হলেও সশরীরে নেওয়া হয়। তাহলেও অন্তত বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা তার সমসাময়িক মানের কাছাকাছি অবস্থান করবে যাও কিনা অবশ্যই যথেষ্ট টেকসই ও আন্তর্জাতিক মানের নয়।

হয়তোবা আমরা আবার ভুলে যাবো। প্রকৃত শিক্ষার স্বাদহীন একটা প্রজন্ম অভিশাপ বৈ আশীর্বাদ অসম্ভব। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আমরা ব্যার্থ প্রজন্মই রয়ে যাবো। বাঙালির হাজার বছরের জ্ঞান মুক্তির স্বাদ অদৃশ্যই রয়ে যাবে।

এখনো সময় নিভু নিভু করে আছে। ঘুরে দাঁড়ানোর নির্দিষ্ট কোন সময়ের প্রয়োজন হয় না, প্রতিটা মুহুর্তেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।

 

লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।