২৯ মে ২০২১, ১০:২৯

উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াতেই মারাত্মক গলদ

লেখক  © টিডিসি ফটো

গত ১৭ মে পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম যে, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের যোগ্যতা সর্ম্পকে বলতে গিয়ে লিখেছেন “তিনি পবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং নীল দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হল শাখার ছাত্রলীগের কার্যকরী কমিটিতে দপ্তর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।”

গতকাল আবার সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। উনার যোগ্যতা বয়ান করতে গিয়ে পত্রিকাসমূহ লিখেছে উনি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি রামেক শাখা ছাত্রলীগ ও রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগসহ ছাত্রলীগের জাতীয় পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৮৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

কয়েক বছর আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল যার যোগ্যতাও বেশ ইন্টারেষ্টিং। উনি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান। গত জাতীয় নির্বাচনে সবার আগে নির্বাচনের বৈধতা এবং তার যৌক্তিকতা নিয়ে নানা বক্তব্য দিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারকে খুশি করেন। এর নাজরানা স্বরূপ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান। গত পরশু দেখলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত স্থগিত চেয়ে উপাচার্য রিট করেছেন। একে তো দুর্নীতি করা অন্যায় আবার তার উপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত যেন না হয় সেএইটা চেয়ে রিট করাতো রীতিমত ডাবল ক্রাইম।

এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য নজরুল ইসলামের কাহিনীতো সবার জানা। তাকে আন্দোলনের মুখে চলে যেতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে যেই বিশ্ববিদ্যালয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন মানুষকে সরকার কেমন করে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিল? আবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে যেই বিশ্ববিদ্যালয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিভাবে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি করে? জাতির পিতার নামে যেই প্রতিষ্ঠান করবেন সেটি কেন নামকাওয়াস্তে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে? কেন বঙ্গবন্ধুর নামে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করছেন না যার সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে যেখান থেকে পড়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা বিশ্বমানের শিক্ষা নিয়ে বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধুর নাম ছড়িয়ে দিবে।

এই মুহূর্তে একটি ঘটনা মনে পরেছে। তখন কেবল বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছে আর আমিও জার্মানী থেকে পোস্ট-ডক শেষ করে দেশে ফিরেছি। দেখলাম এক শিক্ষক নিজে হেটে হেটে নিজের লেখা দুইয়েকটি বই বিলি করে বেড়াচ্ছে। বইটি আর কিছু না বিএনপি নামক দল আর দলের নেতাদের গুণগান। এর কিছুদিন পরই শুনি উনি কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে গেছেন। যদিও একাডেমিক যোগ্যতা বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভ থেকে তেমন খারাপ ছিল না। কিন্তু তিনি একাডেমিক যোগ্যতা দিয়ে উপাচার্য হননি। উপাচার্য হয়েছেন দলান্ধতার পরীক্ষায় পাশ করে।

আর আমরা সবাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের মহা কাহিনীতো প্রায় প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে জানছি। সংবাদ মাধ্যমে জানলাম, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগ জনবল চায়নি, বিভাগের প্লানিং কমিটি কোনো শিক্ষক নিয়োগ চেয়ে সুপারিশ করেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অফিস জরুরি ভিত্তিতে জনবল চেয়ে চাহিদাপত্রও পাঠায়নি। তবে চাহিদা না দেওয়া সত্ত্বেও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান নিয়োগে আরোপিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিজের শেষ কর্ম দিবসে তড়িঘড়ি করে ১৩৭ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে গেছেন।”

‘অবৈধ’ উপায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক পরিবারের সন্তান, প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের নেতাকর্মী। তিনি আবার এই নিয়োগের পক্ষে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে সাফাই গেয়ে বলেছেন, ‘মানবিক’ বিবেচনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। আহারে মানবিকতা। একেকটা মানবিক নিয়োগেরা মাধ্যমে আগামী ৩০ থেকে ৩৫ বছর যাবৎ যত ছাত্র ভর্তি হবে তাদের ভালো শিক্ষক, ভালো কর্মকর্তা ও ভালো কর্মচারী থেকে বঞ্চিত করা হলো। এ কেমন মানবিকতা? কার কাছে বিচার চাইব?

এগুলোসহ বাংলাদেশের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় কারা নিয়োগ পাচ্ছে সেটা একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় সরকার চায় না আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের উন্নতি ঘটুক। তারা চায় না আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের শিক্ষাগ্রহণ করে দেশ গড়ার কাজে লাগুক। উপাচার্য নির্বাচনের ক্রাইটেরিয়া বা নির্ণায়ক দেখলেই বোঝা যায় কেমন উপাচার্য তারা খোঁজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে যদি রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য হয় তাহলে আমরা ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে আশা করব? বর্তমানে যারাই উপাচার্য হচ্ছে তাদের যোগ্যতা বয়ান করতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে এসে যায় ছাত্রজীবনে কোন রাজনীতি করতেন অথবা শিক্ষকতা জীবনে কতবার ক্ষমতাসীন দলের হয়ে শিক্ষক সমিতির নেতা হয়েছিলেন।

এই নিয়োগের জন্য পটেনশিয়াল প্রার্থীদের তালিকা কারা প্রস্তুত করে? সেটা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলারা। আমলারা জানে দলকানাদের নিয়োগ দিলে সরকার খুশি হয়। আমলারা কিভাবে উপাচার্যের যোগ্যতা মাপবে? পটেনশিয়াল উপাচার্যের যোগ্যতা মাপার ইয়ার্ড-স্টিক কি জানা আছে? অর্থাৎ আমাদের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াতেই মারাত্মক গলদ। এখানে বঙ্গবন্ধুর কল্যানে পুরাতন ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় করে এবং এরপর রাষ্ট্রপতি বা চ্যান্সেলর কেবল স্বাক্ষর করেন।

ওয়ার্ল্ড র‌্যাংঙ্কিং-এ ১ হাজারের মধ্যে আছে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন যার উপাচার্য কে হবেন তা নির্বাচন মূলত মন্ত্রণালয় করে। প্রশাসনের লোকজন কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ব্যক্তি নির্বাচন করে এটা আমার মাথায় আসে না। উপাচার্য অনেক বড় একটি পদ। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেতো আরো বিশাল কারণ শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রমোশনসহ সকল কিছুর ক্ষমতা এই জায়গায় কেন্দ্রীভূত। এইরকম একজন মানুষকে মাপার মত যোগ্যতা কি আমলাদের আছে? নাই যে তার প্রমাণ হলো বাংলাদেশে উপাচার্যদের আলোচিত-সমালোচিত নানা কর্মকান্ড। এদের দ্বারা নির্বাচিত কোন উপাচার্যই ভালো কাজ অতীতেও করেনি এবং সময় যত যাচ্ছে তারা যে কত খারাপদের নির্বাচন করছেন তাও প্রমাণিত হচ্ছে।

সম্প্রতি ইউজিসির এক সদস্য বলেছেন, উপাচার্য নিয়োগের জন্য একটা স্বচ্ছ-সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। তিনি বলেছেন এইরকম একটা ক্রাইটেরিয়া থাকলে উপাচার্য হতে চায় যারা তারা নিজেরাও জানবে যে কোন ক্রাইটেরিয়া থাকলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার বাসনা পোষণ করা যায়।

আমার মতে, সময় হয়েছে উচ্চশিক্ষা নামে নতুন একটা মন্ত্রণালয় করা। সেই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে চাকুরি ন্যূনতম যোগ্যতাই হবে পিএইচডি। সেইরকম একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপাচার্য নিয়োগের একটি সার্চ কমিটি করতে হবে। যেই কমিটিতে থাকবে দেশ বিদেশের বরণ্যসব স্কলার ও শিক্ষাবিদ। যারা উপাচার্য নিয়োগের শর্টলিস্টিং করবে। এরপর যারা নিয়োগ পেতে চায়, তাদের প্রেজেন্টেশন হবে। এরপর নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। তাহলে যিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন, তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তিনি জানতে পারবেন যে, হ্যাঁ আমি একটি প্রতিযোগিতামূলক পথে এসেছি। কারো দয়ায় বা অনুগ্রহে আসিনি।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়