ফিলিস্তিনের আর্তনাদ
গাজাবাসীর যা প্রয়োজন, যেভাবে পাশে থাকবেন
- ফয়সাল আকবর
- প্রকাশ: ২২ মে ২০২১, ০৪:৩৪ PM , আপডেট: ২২ মে ২০২১, ০৪:৩৪ PM
ফিলিস্তিন- শতাব্দী ধরে নিপীড়িত এক জনপদ, ক্ষতবিক্ষত একটি আঙিনা। ইহুদিবাদের রক্ষচক্ষুর হিংস্রতায় মানবতা যেখানে অবরুদ্ধ। নিজ মাতৃভূমিতে যেখানে স্বদেশীরা পরবাসী। অন্যদিকে ফিলিস্তিন- সিনা টান টান করে অসম প্রতিরোধের প্রতীক। যেই প্রতিরোধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, শতাব্দী থেকে শতাব্দী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়।
বলা যায়, শেষ আসমানের পর আর কোনো আসমান নেই। শেষ ভূখণ্ডের পর আর কোনো ভূখণ্ড নেই। ফিলিস্তিনিদের আমৃত্যু লড়াই ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই আইরন ডোম, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র এসব মাঝে মাঝে হার মেনে যায় গুলতি কিংবা পাথর খন্ডের কাছে।
পূর্ব জেরুজালেমের আরব অধ্যুষিত শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদ করার এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে এবারের সংকটের শুরু। এরপর আল-আকসা মসজিদে রমজানের সময় ইসরায়েলি পুলিশের বাড়াবাড়ি ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়েছে, পরিস্থিতি করে তুলেছে নাজুক। পরবর্তীতে গাজায় ইসরায়লের টানা ১১ দিনের বিমান হামলা- গাজা উপত্যকাকে পরিণত করেছে এক ধ্বংসস্তুপের নগরীতে। মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। প্রাণ হারিয়েছে আড়াইশত মানবসন্তান। যুদ্ধবিরতিতে আপাতত যুদ্ধাবস্থা থেমেছে। কিন্তু গাজার যে পুর্নগঠন এবং গাজাবাসীর পুর্নবাসন তা অনেক সুদুরের বিষয়।
ইসরায়েলের আমানবিক হামলার প্রতিবাদে এবং গাজার নিরীহ মানুষের পাশে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবিক ও রাজনৈতিক অবস্থান নজরে এসেছে। এবারের ব্যতিক্রম হচ্ছে- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজাবাসীর জন্য সহায়তার উদ্যোগ। এমনকি সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দুরে বাংলাদেশ থেকেও গাজাবাসীর সহায়তায় ফান্ড গঠনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। ফিলিস্তিনবাসীর জন্য এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক তবে এই সহায়তা গাজায় না পশ্চিম তীরে যাবে এটা নিয়ে তৈরি হয়েছে কিছুটা ধুম্রজাল। এই ধুম্রজাল থেকে মুক্তির জন্য আপনার জানা উচিত- ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পরিস্থিতি এবং ব্যতিক্রম ইতিহাস।
প্রকৃতপক্ষে ২০০৬ সাল থেকেই পশ্চিম তীর এবং গাজায় ভিন্ন ভিন্ন শাসনব্যবস্থা বিরাজমান। ইসরায়েলের সাথে আপোষ করেই পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করছে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ্ সরকার। এই আপোষ চুক্তির কারণেই পশ্চিম তীরে নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী নেই, নেই কোন সশস্ত্র ফোর্স। নামে মাত্র একটা সিকিউরিটি ফোর্স আছে, যারা অনেকটাই বাংলাদেশের গ্রাম পুলিশের মতো। তারা ইসরায়েলি পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কাছে অসহায়। এই কারণে পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনীরা ইসরায়েলের দিকে ঢিল আর পাথর ছুঁড়ে। কারণ তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি নেই।
অন্যদিকে গাজা উপত্যকাকে বলা যেতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগার। আবার হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন গাজা উপত্যকা অনেকটাই স্বাধীন। তাদের নিজস্ব মিলিটারী আছে, আছে নিজস্ব অস্ত্রভান্ডার, আর্টিলারি ইউনিট। ইসরায়েলী কোনো বেড়াজালে তারা আবদ্ধ নই। এজন্য গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনীরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে, ইসরায়েলের দিকে রকেট ছুড়ে। গাজার নিয়ন্ত্রণাধীন হামাস সরকার শতভাগ সুন্নি মতাবলম্বী। এই দলটির আয়ের প্রধান উৎস হলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় দেওয়া অনুদান, আর্ন্তজাতিকক সংস্থার আর্থিক অনুদান, ইরান-কাতার-তুরস্ক এবং লেবাননের সামরিক খাতে সহায়তা।
এইটুকু ইতিহাসকে সামনে রেখে আমরা গাজা এবং পশ্চিম তীরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান বুঝে নিতে পারি। এজন্য বাংলাদেশে অবস্থিত ফিলিস্তিন দূতবাসের গঠিত ফান্ডে আপনার অর্থসহায়তা কতটুকু হামাস বা গাজাবাসীর কাছে পৌছবে? সেই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- আপনি চাইলেই এই ফান্ডে অর্থ সহায়তা দিতে পারেন। কারণ গাজায় আপনার সহায়তা পৌছানোর বিকল্প আর কোন পদ্ধতি আপনার হাতে নেই। এছাড়া গাজা ফিলিস্তিনের অংশ এবং প্রতি বছর ফিলিস্তিনের যে জাতীয় বাজেট হয় সেই বাজেটে গাজা শহরের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়।
তাই পশ্চিম তীর এবং গাজার জন্য ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন দূতাবাসের ফান্ডে আপনার সহায়তা পৌছাতে পারেন। অর্থ সহায়তা পাঠানোর নম্বরগুলো হলো : ০১৭১৫৮৩৩৩৩০২ (রকেট-পারসোনাল), ০১৭১৫০৮১৮৩৯ (বিকাশ-পারসোনাল), ০১৭১৫০৮১৮৩৯ (নগদ-পারসোনাল), ০১৩০১৭৯৪২৯৫ (বিকাশ-পারসোনাল), ০১৫৩১৭১২৯৪৫ (বিকাশ-পারসোনাল)। এছাড়া বিকাশ অ্যাপে ডোনেশন অপশনে গিয়ে আপনি এই সহযোগিতা দিতে পারেন।
গাজাবাসীর সহায়তায় আরও যেসব পথ
এক. ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন দূতাবাসের মাধ্যমে সহায়তায় আপনার মনে দ্বিধা থাকলে সরাসরি বাংলাদেশে অধ্যয়নরত গাজার শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। বাংলাদেশে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন আছে - General Union Of Palestinian Students In Bangladesh । বর্তমানে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন হাতেম রাবা নামে এক শিক্ষার্থী। সংগঠনটির ফেসবুক পেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সরাসরি সহায়তা প্রদান করতে পারেন।
দুই. গাজায় যেসব আর্ন্তজাতিক সংস্থার ভূমিকা দৃশ্যমান তার মধ্যে IHH অন্যতম। এটি তুরস্কের সর্ববৃহৎ বেসরকারী দাতব্য সংস্থা। ২০১০ সালে গাজার অবরোধকে ভেঙ্গে দেওয়ার লক্ষ্যে IHH এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের নির্দেশনায় গাজামুখী ত্রানের জাহাজের কনভয়ে ইসরায়লের হামলার কথা অনেকের মনে থাকার কথা। IHH তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই হামাসকে সাহায্য করে আসছে এবং এবারও তারা সেখানে গাজা বাসীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে আসছে। বাংলাদেশ থেকে যারা সরাসরি ফিলিস্তিনিদেরকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন বিশেষ করে গাজাবাসী ও হামাসকে তারা এই লিঙ্কে [www.ihh.org.tr/en] গিয়ে খুব সহজেই টাকা পাঠাতে পারেন।
তিন. গাজায় দৃশ্যমান আরেকটি সংগঠনের নাম হচ্ছে Anera। ১৯৬৮ সাল থেকে গাজা, পশ্চিম তীর, লেবানন, জর্ডানে মানবিক অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে সংস্থাটি। এই সংস্থাটি গাজা উপত্যকার বিভিন্ন ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য, চিকিৎসা সেবা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। অুনদান বা সহায়তার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট [www.anera.org/where-we-work] থেকে জানতে পারবেন।
চার. যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন Islamic Relief চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন। খাদ্য সহায়তা, মেডিক্যাল সহায়তা এবং গাজার অনাথ শিশুদের স্পন্সরশিপ নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি। এই সংস্থায় অুনদান বা সহায়তার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য তাদের ওয়েবসাইট [www.islamic-relief.org.uk/rebuild-gaya] থেকে জানতে পারবেন।
পাঁচ. Muslim aid লন্ডনকেন্দ্রিক এই সংস্থাটি ১৯৮৫ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। গাজায় ওয়াটার ফর গাজা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ মানবিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ বিভিন্ন সহায়তা করে যাচ্ছে। অুনদান বা সহায়তার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট [www.muslimaid.org/appeals/save-palestine-emergency/] থেকে জানতে পারবেন।
ছয়. গাজাবাসীর মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে কাজ করে যাচ্ছে এমন সংস্থার মধ্যে UNRWA USA National Committee (UNRWA USA) অন্যতম। গাজা উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম সহ লেবাননে শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই সংস্থা। অুনদান বা সহায়তার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট [www.unrwausa.org/ramadan] থেকে জানতে পারবেন।
যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন
বাংলাদেশে গাজাবাসীর সাথে যোগাযোগ রাখে এমন এক তরুণের সাথে দীর্ঘ আলাপ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজাবাসীর সাথে কথোপকথন থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে- আমরা বাংলাদেশ থেকে চাইলে কিছু কার্যকর সহায়তা প্রকল্প নিতে পারি। আমার ব্যক্তিগত অনুধাবন ফিলিস্তিনে যুদ্ধের অন্যতম ক্ষতিকর দিক হলো সেখানকার তরুণরা বিশেষ করে গাজার তরুণরা। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগে, শিক্ষাজীবন নিয়ে উৎকন্ঠায় থাকে। এমনকি গাজায় তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও কম না। এক্ষেত্রে এসব তরুণদের পুর্নবাসনের জন্য একটা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমার জানামতে, প্রতিবছর ফিলিস্তিন দূতাবাসের মাধ্যমে ১৬ শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজগুলোতে এমবিবিএস ও বিডিএস প্রোগ্রামে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের সমবেতনে পড়াশোনা করতে পারে। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিন শিক্ষার্থীরা সার্কভূক্ত দেশের শিক্ষার্থীদের মতো প্রতি বছরে ৬০০ মার্কিন ডলার টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আছে।
বাস্তবতা হল গাজার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই বছরে কেবল টিউশন ফি বাবদ এই ৬০০ ডলার খরচ করার সামর্থ্য নেই। কারণ ২০০৬ সাল থেকে অবরুদ্ধ গাজায় কার্যত কোন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নেই। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান ও পারিবারিক খামারে ছোটখাট কৃষিপণ্যের উৎপাদনব্যতীত গাজায় আর কোন উৎপাদন নেই। বেশিরভাগ পরিবারই অভাবগ্রস্ত। তারমধ্যেই যুদ্ধের বিভীষিকা তো আছেই।
এমনই প্রেক্ষাপটে গাজার তরুণ শিক্ষার্থীদের একটা জেনারেশন গড়ে দিতে বাংলাদেশ সরকার চাইলেই একটি উদ্যোগ নিতে পারে। সেটি হচ্ছে প্রতিবছর গাজা এবং পশ্চিম তীরের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নির্দষ্টি সংখ্যক পূর্ণাঙ্গ স্কলারশীপ চালু। সরকারি উদ্যোগের বাইরে বাংলাদেশের ভালোমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিংবা বড় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান, কিংবা বড় মাপের ব্যবসায়ীরাও গাজার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারে।
এটা সত্য যে, আমরা ব্যক্তিগতভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল; অনেকেই প্রতিবছর কয়েকজন শিক্ষার্থীর পুরো শিক্ষাজীবনের খরচ নির্বাহের ক্ষমতা রাখেন; যুদ্ধাবস্থায় কেউ কেউ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন, কেউ এমনকি যুদ্ধেও যেতে চান। কিন্তু আমরা যদি ফিলিস্তিনিদের জন্য কার্যকর এবং টেকসই সহযোগিতা করতে চাই তাহলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য শতভাগ স্কলারশীপ সুবিধা ব্যবস্থা করতে পারি।
আমি নিশ্চিত, গাজাবাসীর জন্য এমন একটি প্রচেষ্টা অনেক বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। ফিলিস্তিনিরাও এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা অবকাঠামোর অগ্রগতিতে এবং গাজাবাসীর উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এমনই এক মৌলিক প্রয়োজনে সামর্থ্যবানরা এগিয়ে আসবেন- এই প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: সিনিয়র লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি