শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই

ড. কামরুল হাসান মামুন
ড. কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ছবি

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের আত্মহত্যা। গত ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেরিতে হলেও কিছু কিছু অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সংযুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেই অনলাইন ক্লাসকে সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল তা হলো হাই স্পিড ইন্টারনেট কানেকশন এবং এর সুলভ মূল্য।

আমাদের সরকার বা প্রতিষ্ঠান কেউই দুটোর কোনটিই করেনি। আমাদের মোবাইল কোম্পানিগুলো সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি লাভ করে কিন্তু তারা কোন সামাজিক রেসপনসিবিলিটি পালন করে না। তারা পারতো এই বিষয়টাকে এড্রেস করতে কিন্তু করেনি।

লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী তাদের জীবনের শ্রেষ্ট সময়টা এইরকম একটা অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর যে কি বিশাল ইমপ্যাক্ট সেটা কোথাও তেমন কোন আলোচনা নাই। এই ক্ষতিকে মিনিমাইজ করার কোন সিরিয়াস প্রয়াস কখনো দৃশ্যমান হয়নি। মনে হয়েছে সরকার রিস্ক-ফ্রি থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে কিছু রিস্ক আছে। সেগুলোকে কমাতে অনেক কাজ করতে হতো, টাকা খরচ করতে হতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাইলে সরকাকে দোষারোপ করার আশংকা আছে।

তাই সবচেয়ে সহজ পথ হলো বন্ধ রাখা। কোন কাজ নাই তাই ভুলও নাই। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে সরকারের জন্য অনেক সুবিধা। কারণ স্বাস্থ্য খাত সহ নানা ইস্যুতে ছাত্ররাই প্রতিবাদ করে। এখন রাস্তায় প্রতিবাদ করার কেউ নাই। এই সুযোগে টিএসসি ভাঙা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটাসহ নানা দুর্নীতির ইস্যুতে কোন আন্দোলন প্রতিবাদ নাই। সরকার সম্ভবত এর চেয়ে আরামের সময় আর কখনো কোন সরকার পায় নাই।

করোনা সংক্রমণের দিক থেকে আমাদের যা অবস্থা তা কখনোই তেমন খারাপ অবস্থায় যায়নি। আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা নিয়েও পৃথিবীর অনেক দেশ স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার চিন্তা করেনি। তারা সব সময় তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা জারি রেখেছে কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। আমাদের সমস্যা হলো স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অবকাঠামোর মারাত্মক সংকট। সরকার কখনো এইটাকে গুরুত্ব দেয়নি। দেয়নি তার কারণ যারা গুরুত্ব দেওয়ার দায়িত্বে তারা দেশের চিকিৎসা নেয় না।

যার ফলে এইখাতে বরাদ্দ পৃথিবীতে প্রায় সর্বনিম্ন। যতটুকুওবা বরাদ্দ দেয় তার বড় একটা অংশ দুর্নীতি খেয়ে ফেলে। ফলে প্রতিদিন ১০০ রোগী মারা গেলেই সারা দেশের মানুষদের মধ্যে প্যানিক এটাক হয়। আইসিইউ এর দরকার হলে ভিআইপির কানেকশন ব্যতীত পাওয়া যায় না। এই ব্যর্থতার কারণে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুলতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতার দায় বহন করছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। যা খুবই দুঃখজনক।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এইটা যেমন একটা সমস্যা একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য কর্তৃপক্ষের মাঝে যথেষ্ট চিন্তার অভাব আমার কাছে আরো বেশি ভয়াবহ মনে হয়েছে। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণরুম সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যার ফলে চার জনের একটি রুমে ৫০ জন থাকে এই অবস্থা রেখে কি বিশ্ববিদ্যালয় আর কখনো খোলা সম্ভব? এইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়েও আলোচনা দেখিনা। আমরা করোনা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে অনেক দিনের অনেক বড় একটা সমস্যা সমাধানের একটা কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি। যার মাধ্যমে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গণরুম এবং টর্চার সেল থেকে মুক্তি পেয়ে একটা সুস্থ স্বাভাবিক লেখাপড়ার পরিবেশ পাবে।

গতরাতে দেখলাম আমার এক প্রিয় সহকর্মী ফেরদৌস আমান (Ferdous Aman) এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন যে, যেভাবেই হউক বাংলাদেশের শহরের অনেক ঘনবসতি এলাকায় মানুষরা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করে ফেলেছে। আসলে আমাদের শহর এলাকায় অনেকেই টিকা নেওয়ার কারণে ইমিউনিটি অর্জন করেছে অথবা মাইল্ড এসিম্পটোমেটিক আক্রমণের কারণে ইমিউনিটি অর্জন করেছে। এখন সরকারের উচিত মাস স্কেলে এন্টিবডি টেস্ট করে দেখা।

বিশেষ করে যারা দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছে তাদের এই টেস্ট জরুরি। দ্রুত statistically গ্রহণযোগ্য স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করে দেখা সত্যি সত্যিই কি আমরা ইমিউনিটি অর্জন করেছি কিনা। যদি করে থাকি তাহলে সুসংবাদ। আমরা অতি দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারি। তথাপি আগের সেই নরমাল আর ফিরে যাওয়া যাবে না। আমাদের নতুন নরমালে অভ্যস্ত হতে হবে। সেটা হলো মাস্ক পরা, হ্যান্ড সেনিটাইজ করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। আমরা আমাদের ক্লাসের সাইজ ছোট করে শিফটে ক্লাস নিতে পারি। এইসব নানা ব্যবস্থা নিতে পারি।

হাত গুটিয়ে বসে থাকা অন্যায়। এত ছাত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা অবহেলা করতে পারিনা। এই ১ বছর বন্ধ থাকার কারণে তাদের উপর মানসিক ইমপ্যাক্ট কতটা হয়েছে সেটাও গবেষণা করে দেখা দরকার। By the way, ইতালির জনসংখ্যা আমাদের তিন ভাগের এক ভাগ। ওখানে এখনো প্রতিদিন ৩৫০-৪০০ জন করোনায় মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে খারাপ অবস্থাও এর তিন ভাগের এক ভাগ খারাপ। সেখানে স্কুল খোলা।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ