মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমরা মার খাচ্ছে, অতএব বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়বে!

গাজায় ইজরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর
গাজায় ইজরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর  © বিবিসি

কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে জেরবার ভক্তদের আপাতত টাইম লাইন ভরে গিয়েছে ‘স্ট্যান্ড উইথ ইজরায়েল’ হ্যাশটাগে। তাদের ভাবখানা এমন, মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমরা মার খাচ্ছে, অতএব ভারতবর্ষে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়বে! সমস্যা হচ্ছে ভক্তকুলের সাধারণ জ্ঞান এতই খারাপ, যে তারা এটাও জানে না, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন পক্ষের সমর্থনে দাঁড়ালে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।

এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে লাফিয়ে পড়ে নরেন্দ্র মোদী নিজে এবং তাঁর অনুগামীরা যথেষ্টই মুখ পুড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও শিক্ষা না নিয়ে আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিজেদের হাতিয়ার করতে ব্যাগ্র এই ভক্তকুল।

সমস্যা হচ্ছে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে জেরবার। ভক্তকুল হয়তো জানে না, গত দু’বছরে ইজরায়েলে কোনও স্থায়ী সরকার তৈরি হতে পারেনি। একের পর এক নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু কোনও নির্বাচনই নেতানিয়াহু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসতে পারেননি। তাই ভারতবর্ষে যেমন রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে গেরুয়া শিবিরকে আগ্রাসী হতে হয়, ঠিক তেমনই ইজরায়েলের রাজনীতিতেও কোণঠাসা নেতানিয়াহু-র জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিল প্যালেস্তাইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরা।

ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, ঘটনাচক্রে যাঁকে আবার ভারতবর্ষের গেরুয়া শিবির ‘রোল মডেল’ এবং নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু বলে প্রচার করতে বদ্ধপরিকর, সেই নেতানিয়াহু একই রকম ভাবে আগ্রাসী রাজনীতির পথে হেঁটে প্যালেস্তাইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন। সেই সংঘর্ষ এমনই রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী চেহারা নিয়েছে, যে গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক সমীকরণ আবার নতুন করে তৈরি হতে শুরু করেছে।

ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের এবারের সংঘর্ষের সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, সেটা ক্রমশই ইজরায়েলের ভেতরেও জাতিদাঙ্গা এবং জাতিবিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, ইজরায়েলের ভিতরেও ইহুদি এবং আরবদের মধ্যে বিভিন্ন শহরে সংঘর্ষ হচ্ছে। যা রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েলের জন্য মোটেই স্বস্তিকর বিষয় হতে পারে না। তাছাড়া ইজরায়েল যেভাবে প্যালেস্তাইনের উপর বোমাবর্ষণ এবং সামরিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজ নতুন করে আলোড়িত হচ্ছে, এবং প্যালেস্তাইনের সমর্থনে একজোট হচ্ছে।

মুসলিম বিশ্বে এই ক্ষোভ এবং আলোড়ন তুরস্কের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমনই আমাদের ঘরের পাশে বাংলাদেশেও একই চিত্র ধরা পড়েছে। যখন গোটা বিশ্ব করোনার থাবায় জর্জরিত, তখন কোন আক্কেলে ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বা স্থিতাবস্থাকে বদলে দিতে চাইলো, তা এখও পরিষ্কার নয়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইজরায়েলের বরাবরের বন্ধু আমেরিকা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকতে পারেনি, ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। আমেরিকা যদিও ইজরায়েলের আত্মরক্ষার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে, অর্থাৎ প্যালেস্তাইনের ক্ষমতাসীন হামাসের রকেট হানার থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তেল আভিভের সামরিক পদক্ষেপের পাশে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে ওয়াশিংটন বুঝতে পেরেছে গাজা ভূখন্ডে চলতে থাকা বোমাবর্ষণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্য বা আরবদেশগুলোর সঙ্গে এতদিন ওয়াশিংটনের যে ঘনিষ্ঠতা বা সখ্যতার সম্পর্ক ছিল, তা নষ্ট হয়ে যাবে যদি গাজাতে মুসলিমদের রক্ত এইভাবে ঝড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ইতিমধ্যেই চীনকে সঙ্গে নিয়ে প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। রাশিয়া এবং চীন রাষ্ট্রপুঞ্জে গাজা ভূখন্ডে হামলা নিয়ে আলোচনা চায়। প্যালেস্তাইনের পাশে মস্কো এবং বেইজিং, আর ইদের সময় মুসলিমদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে ফুঁসতে থাকা ইসলামী বিশ্ব ওয়াশিংটনের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক বিষয় হতে পারে না।

গাজায় ইজরায়েলের আক্রমণ আরও আলোড়ন তৈরি করেছে, কারণ এই গোটা ঘটনাটাই ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যে ইদ উদ্‌যাপনের সময়। ইজরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্তাইনের বাসিন্দাদের প্রাথমিক সংঘর্ষের কারণ মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র বলে পরিচিত একটি মসজিদে নেতানিয়াহু-র পুলিশবাহিনী ঢুকে পড়া। একটি স্থানীয় সংঘর্ষ, কিন্তু যা গোটা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়, তাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা আবার মধ্যপ্রাচ্যকে বারুদের স্তূপের উপর বসিয়ে দিয়েছে।

ওই পবিত্র মসজিদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা দিয়ে যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, তাই আজ ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। প্যালেস্তাইনের শাসক হামাস গোষ্ঠী যেমন ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট ছুঁড়ছে, তার পরিণতিতে ইতিমধ্যেই সাত জন মারা গেছেন, তেমনই তেল আভিভও পাল্টা আক্রমণে গিয়ে গাজা ভূখন্ডে যথেষ্ট বোমাবর্ষণ করেছে। ইজরায়েলের এই বোমাবর্ষণে গাজাতেও মৃতের সংখ্যা একশোর বেশি।

ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের সংঘর্ষে মৃত্যু এবং অনিশ্চয়তা গত ৫০ বছরের একমাত্র বাস্তব। কিন্তু সেই বাস্তব যখন গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজকে আন্দোলিত করে, তুরস্ক থেকে ইরান একই সুরে কথা বলে, আর সেই মুসলিম কণ্ঠস্বরের পাশে দাঁড়ায় রাশিয়া এবং চিনের মতো শক্তিধর রাষ্ট্র, তখন গোটা বিশ্বতে উত্তেজনাকার পরিস্থিতি তৈরি হয় বইকি!

কলকাতা২৪ এর মন্তব্য প্রতিবেদন


সর্বশেষ সংবাদ