স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের কৌশলে সফল সাবেক ভিসি অধ্যাপক সোবহান!
- ড. মু. আলী আসগর
- প্রকাশ: ০৮ মে ২০২১, ১১:৫৩ PM , আপডেট: ০৮ মে ২০২১, ১১:৫৩ PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর মূল উদ্দেশ্য ‘Improving the Teaching and Research’ (তথ্য সূত্র : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার; চ্যাপ্টার-১)। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উন্নতমানের শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে প্রায় আড়াই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে ‘শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা’ অনুমোদিত হয়, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ নামে পরিচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫-এর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, অনার্স ও মাস্টার্সে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) প্রাপ্তদের মধ্যে শুধু প্রথম থেকে সপ্তম স্থান অধিকারীরা আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ৭ মে অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ২য় মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর, একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ ব্যাপকভাবে শিথিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করেন।
২০১৭ সালে শিথিলকৃত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর মূল উদ্দেশ্য ''Improving The Teaching and Research' থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিচ্যুত হয়ে রাবির শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পথ সুগম করা হয়েছে।
২০১৭ সালে শিথিল করা শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় সব অনুষদের ক্ষেত্রে ১ম থেকে ৭ম স্থান অধিকারীদের আবেদনের যোগ্যতাটি শিথিল করা হয়। ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় অন্যান্য অনুষদের (বিজ্ঞান অনুষদ, জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদ, কৃষি অনুষদ এবং প্রকৌশল অনুষদ) আবেদনের ন্যূনতম সিজিপিএ (অর্থাৎ CGPA ৩.৫) ঠিক রেখে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, আইন অনুষদ, কলা অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও চারুকলা অনুষদের আবেদনের যোগ্যতা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫)-এর নিচে নামিয়ে আনা হয়। এমনকি, কিছু অনুষদে আবেদনের যোগ্যতা সিজিপিএ তিন দশমিক শূন্য (CGPA ৩.০) করা হয়।
উল্লেখ্য, সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের মেয়ে সানজানা সোবহান বিজনেস স্টাডিজ অন্তর্ভুক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করে ২২তম অবস্থানে থেকে শিক্ষক হয়েছেন এবং উপাচার্যের নিজ জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজ বিজনেস স্টাডিজ অন্তর্ভুক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৪৭৯ (CGPA ৩.৪৭৯) পেয়ে ৬৭তম অবস্থানে থেকে শিক্ষক হয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অন্তর্ভুক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের মেয়ে ও জামাতা উভয়েই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। রাবির বিজনেস অনুষদ অন্তর্ভুক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় যথাক্রমে ৪০, ৫১ ও ২৬ জন শিক্ষার্থী সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) বা অধিক সিজিপিএ পেয়েছিল এবং একই বিভাগ থেকে এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় ২০১২, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় যথাক্রমে ৬৬, ৪৭, ৬১ ও ২৫ জন শিক্ষার্থী সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) বা অধিক সিজিপিএ পেয়েছিল।
যুক্তিযুক্ত কারণে এটি মনে করা স্বাভাবিক যে, রাবির বিজনেস অনুষদ অন্তর্ভুক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে এত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) এবং অধিক সিজিপিএ পাওয়ার পরও শুধু সাবেক ভিসি অধ্যাপক সোবহানের জামাতা ২০১২ সালের এমবিএ পরীক্ষায় সিজিপিএ ৩ দশমিক ৪৭৯ (CGPA ৩.৪৭৯) পাওয়ায় এবং অধ্যাপক সোবহানের মেয়ে ২০১২ সালের এমবিএ পরীক্ষায় ২২তম অবস্থানে থাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ শিথিল করা হয়। কারণ রাবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫-এর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, অনার্স ও মাস্টার্সে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) প্রাপ্তদের মধ্যে শুধু ১ম থেকে ৭ম স্থান অধিকারীরা আবেদন করতে পারবেন। পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান অনুষদ, জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদ, কৃষি অনুষদ এবং প্রকৌশল অনুষদে তুলনামূলক কম বা সমপরিমাণ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) পেলেও, ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় এই চারটি অনুষদ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের আবেদনের ন্যূনতম সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ (CGPA ৩.৫) রাখা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ স্থগিতের নির্দেশনা ও ইউজিসির এডহক নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিদায়বেলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪১ জনকে নিয়োগ দেওয়া উপাচার্যের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ১৪১ জন নিয়োগে একটি চক্র নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ টাকা গেছে অধ্যাপক সোবহানের পকেটে। গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহীতে আলোচিত ছিল, নিয়োগ নিয়ে অনেকের কাছে টাকা নেওয়া হয়েছে।
নিয়োগপ্রাপ্ত তালিকায় দেখা গেছে, নিয়োগ পাওয়া ১৪১ জনের মধ্যে ১১ জনকে শিক্ষক, ২৩ জনকে কর্মকর্তা, ৮৮ জনকে উচ্চমান সহকারী ও ৯ জনকে ইমাম হিসেবে অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রাবি প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ভিসি নিয়োগের নথিতে সই করতে বললেও রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম তাতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর অধ্যাপক সোবহান একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে দিয়ে নিয়োগপত্রে সই করিয়ে নেন।
অধ্যাপক সোবহানের বিরুদ্ধে ইউজিসি কর্তৃক তদন্তে তার অসংখ্য অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও তিনি সফলভাবে তার উদ্দ্যেশ্য পূরণ করে গত ৬ মে মেয়াদ শেষ করেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ বারংবার লঙ্ঘন করে কিছু বিভাগের সভাপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করে তিনি উদ্দেশ্যে ও কৌশলে সফল!
লেখক: অধ্যাপক, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ ও সাবেক প্রাধ্যক্ষ, মতিহার হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়