অতিরিক্ত সচিবকে কোষাধ্যক্ষ: উচ্চ শিক্ষার বারোটা বাজার ঘন্টা
গতকাল থেকে আমার মেসেঞ্জার ইনবক্সে একের পর এক মেসেজ আসতে থাকে। সাথে থাকে একটি স্ক্রিনশট। বিষয়টি হলো এলপিআরে যাওয়ার জন্য তৈরী এমন একজন আমলাকে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসাবে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি ফেইসবুক গ্ৰুপে গিয়ে দেখলাম সঙ্গত কারণেই প্রতিবাদ এবং রাগ প্রকাশের ঝড় বইছে সেখানে। আমার নিউজফিডেও একই অবস্থা। এত বড় একটি ঘটনা কিন্তু এটি আমাদের গণমাধ্যমে তেমন আসেনি বললেই চলে। মানে দেশ সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই না। আমি গতকাল কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিনি। কারণ বিষয়টি নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবার ব্যাপার আছে।
আমার মাথায় প্রথমেই যেই প্রশ্ন জাগে সেটা হলো সরকার কেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার নামে যেই বিশ্ববিদ্যালয় বানানো হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই কেন? এই নামে যেই বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেটির জন্যতো সরকারের বিশেষ দৃষ্টি থাকার কথা যাতে এইটা হয় দেশ সেরাই শুধু না টার্গেট থাকবে বিশ্বসেরাদের মধ্যে অন্যতম হওয়া। তারপরেই বুঝতে পারি আমি কত naive চিন্তা করি। আরে স্বয়ং জাতির পিতার নামে যেই বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে কেমন মানুষকে ভিসি নিয়োগ দিয়েছিল মনে আছে? সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কেউ কম্পিউটার চুরি করে। শুধু তাই না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নামে যেই বিশ্ববিদ্যালয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই একটি কলেজ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়। এই নামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বুঝুন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল নিয়ে তারা কেন ভাববে? ভাবেনা। দেশ, শিক্ষা আর নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি সরকার সত্যি সত্যিই ভাবতো তাহলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একের পর এক অযোগ্যদের ভিসি প্রোভিসি কোষাধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ দিত? তার মানে উচ্চ শিক্ষার বারোটা বাজার ঘন্টা শুরু হচ্ছে বঙ্গবন্ধ, বঙ্গমাতা এবং বঙ্গকন্যার নামে বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই।
অনেক ভেবে আমার মনে হলো এমনইতো হওয়ার কথা। আমাদের এত রাগ হচ্ছে কেন? আগেই কেন বুঝতে পারিনি? বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার সকল প্রকার বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের যেই নাটক গত বেশ অনেক বছর যাবৎ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘটে আসছে এটি সেই নাটকের শেষ প্রান্ত। বিষয়টা স্কুল কলেজ লেভেল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার ভিত্তিতেই এই ধ্বংস লীলা চলে আসছে। এইটা হয়ে আসছে আমলাদের নেতৃত্বে। আর এরা সফল হচ্ছে যেহেতু সরকার এখন প্রচন্ড জনগণ নির্ভর না হয়ে আমলা নির্ভর হয়ে পরেছে। আমরা যারা বুঝতে পারছিলাম তারা অনেক আগে থেকেই এই নিয়ে কথা বলে আসছি কিন্তু সাধারণ শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এইসব নিয়ে কথা বলে সরকারের বিরাগভাজন হতে চায়নি। আর আমাদের শিক্ষক রাজনীতি করে যারা নেতৃত্বে যান তাদের কথা আর কি বলব। এই দেশে নেতা হওয়ার প্রধান গুন্ হলো অযোগ্যতা। অযোগ্য মানুষরা চরম স্বার্থপর হয়। এরা কেবল নিজের স্বার্থই বুঝে।
পেছন ফিরে একটু তাকান দেখবেন সব ফকফকা হয়ে যাবে। ২০১৫ নতুন পে স্কেল করার সময়ই একটি বড় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে ফেলে। সেখানে অতীব চতুরতার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে কয়েক ধাপ নামিয়ে দেওয়া হলো। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুকলোতে এমন শিক্ষক থাকেন বা থাকা উচিত যাদের ওই ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সের সর্বোচ্চ জায়গায় বসালেও কম হয়ে যায়। আপনারা কোন জায়গায় বসাবেন huh? দুইদিন আগে যাদের কাছ থেকে শিখে চাকুরী নিয়ে মাস্টার্স পাশ ওটাইতো অধিকাংশ ক্ষেত্রে থেকে যায়। আর শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে তারা সারা জীবন জ্ঞানের প্রবাহে থেকে জ্ঞান সৃষ্টি করে যান। শিক্ষকরা পিএইচডি করেন, পোস্ট-ডক করেন, পিএইচডি ডিগ্রী সুপারভাইস করে পিএইচডি ডিগ্রী প্রদান করেন আর তাদের অবস্থানের অবনমন? কিছুদিন আগে সেনাপ্রধান পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন একজন শিক্ষকের অধীনে যার ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে অবস্থান উনার সুপারভাইসরের উপরে। জ্ঞান যদি পানির প্রবাহের মত ধরি তাহলে জ্ঞানতো এখানে উল্টো দিকে প্রবাহিত হলো।
ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০১৫ সালে নতুন বেতন স্কেলে অধ্যাপক পদের পর আরো দুটি ধাপ আছে। সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদোন্নতি হলে আগে যেটি অধ্যাপক ছিল সেটি হয়ে গেল গ্রেড ৩ অধ্যাপক এবং এর পর আরো দুটি ধাপ। সেই দুই ধাপে গিয়েও সিনিয়র সচিব, সেনা প্রধান, পুলিশ প্রধান এইপদগুলোর নিচে। আসল কথা হলো শিক্ষকদের কোন ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্স লাগে না। শিক্ষকদের জন্য দরকার ছিল স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। কারণ শিক্ষকতা একটি ভিন্ন পেশা। এর সাথে অন্য কোন পেশার তুলনা করাই উচিত না।
ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে নামানোই কেবল একমাত্র ষড়যন্ত্র না। তারপর শুরু হলো প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ। এইটার মাধ্যমে দেশের ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রী করতে পাঠানো শুরু হলো। অথচ উচিত ছিল ফেললোশিপের এই টাকা দিয়ে দেশে গবেষণার পরিবেশ তৈরী করে আমাদের অধীনে পিএইচডি করানো। প্রয়োজনে উচ্চ মানের বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে দেশি বিদেশী শিক্ষকদের যৌথ সুপারভিশনে পিএইচডি ডিগ্রী দেওয়া যেতে পারতো। এতে দেশে গবেষণার পরিবেশ তৈরী হতো। একই সাথে আমাদের কলেজের শিক্ষকরাও পিএইচডি করতে পারতো। যেটা হতো sustainable উন্নয়নের একটি বড় ধাপ। তা না করে একেক জনের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে পিএইচডি করিয়ে আনা খুবই অন্যায়। এখন তারা পিএইচডি করে এসে বলবে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রোভিসি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কি আগে বুঝতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হলে কেবল পিএইচডি ডিগ্রীই যথেষ্ট না। বিশ্ববিদ্যালয় কি জানতে হলে শিক্ষকতা করতে হবে, গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি করতে হবে, হলের প্রভোস্ট বা ডিন হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে যা কেবল একজন শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব। এই জন্যই শিক্ষককেই হতে হবে ভিসি-প্রোভিসি বা কোষাধ্যক্ষ।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)