শ্রীলঙ্কা কি মিয়ানমারের পথে হাঁটছে?
শ্রীলঙ্কা সাংবিধানিকভাবে এশিয়ার বৌদ্ধ সংখ্যা গরিষ্ঠ এক দ্বীপরাষ্ট্র। ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত এই দেশটার জনসংখ্যা প্রায় ২২ মিলিয়ন। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০% বৌদ্ধ, ১৫% তামিল (হিন্দু), ৯% মুসলিম এবং অবশিষ্ট ৬% খ্রিস্টান ও অন্যান্য।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীলতা থাকলেও দেশটি সংখ্যালঘুদেরকে মূলধারায় কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিপেক্ষিতে ৭০-এর দশকে তামিলরা জাফনা দ্বীপকে শ্রীলঙ্কা থেকে আলাদা করে আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে। এক সময় তামিলরা পৃথিবীর অন্যতম সেরা গেরিলা সংগঠন গড়ে তোলে।তারা নিজস্ব বিমান বাহিনীও গড়ে তোলে, সাথে শক্তিশালী স্থল বাহিনী, জাফনাতে তাদের নিজস্ব নৌ উইং ছিল।
এরা ভারতের তামিলের সহযোগিতা পেত। এদের প্রধান ছিলেন ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ। দীর্ঘদিন বিভিন্ন আন্দোলন করলেও মাহিন্দ্র রাজাপক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসলে ২০০৯ সালে তামিলদের সাথে যুদ্ধে তামিল প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের হত্যার মধ্যে দিয়ে তামিল আন্দোলনকে ধামা চাপা দেওয়া হয়। বর্তমানেও রাজাপক্ষের পরিবার দেশটির শাসন ক্ষমতায়।
দেখুন: বোরকা নিষিদ্ধ করছে শ্রীলঙ্কা, আছে মাদ্রাসা বন্ধেরও পরিকল্পনা
তামিলদের পতনের পর ২০০৯ সাল থেকে বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা ইসলামোফোবিয়ার আশ্রয় নিয়ে মুসলিমদের টার্গেট করতে থাকে। এক্ষেত্রে, মুসলমানরা দীর্ঘদিন শান্তিতে বসবাস করলেও বর্তমান চিত্র অনেকটায় ভিন্ন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, মিয়ানমারের বৌদ্ধদের রোহিঙ্গা মুসলিমনিধনে উৎসাহিত হয়ে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরাও দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।
গত দুই দশকে দেশটিতে বৌদ্ধদের উগ্রবাদীতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দেশটিতে মুসলিমরা বেশ কয়েকবার আক্রমণের মুখে পড়ে। এখনো মাঝে মাঝেই দেশটিতে মুসলিমদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রার্থনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।
২০১৯-এর ইস্টার সানডের দিন ২টি ক্যাথলিক চার্চ, ১টি প্রোটেস্টেন্ট চার্চ এবং ৩টি হোটেলে একযোগে বোমা হামলা হয়। এতে প্রায় ২৬০ জন নিহত হয়। এ বোমাহামলার জন্য মুসলমানদের দায়ী করে একের পর এক মুসলিম বিদ্বেষী আইন পাস করে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের প্রতি চাকরি, ধর্ম পালন প্রভৃতি ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা খুশি হলেও মুসলিমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে।
ইতোমধ্যে দেশব্যাপী মুসলমানদের হাজার হাজার ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষত মাদ্রাসা সরকারিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মুসলিম ছেলে মেয়েরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন কি যারা ইতোপূর্বে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে চাকরী বা কর্মে নিয়োজিত আছে তারাও তাদের অবস্থান নিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় পার করছে।
কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে মুসলিম মেয়েদের ইসলামী পোশাক বোরকা নিষিদ্ধের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। গত সপ্তাহে ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডে বোরকা নিষিদ্ধের উপর গণভোট হওয়ার পর এই সপ্তাহে শ্রীলঙ্কাতে প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পাস করা হয়। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বোরকা নিষিদ্ধ করায় মুসলিম মেয়েরা এখন থেকে আর বোরকা পরতে পারবেনা।
এটা আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এটাকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকারের উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ হিসেবে এ আইনের নিন্দা করেছে। দেশটির মুসলিমরা এ প্রস্তাব পাস হওয়ায় এটাকে ধর্ম পালনের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
সংখ্যা গরিষ্ঠ বৌদ্ধদের ভোটব্যাংকের হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার কোন সরকারই বৌদ্ধ চরমপন্থার ক্রমবিকাশের দিকে নজর দেয়নি। উপরন্তু আরো রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। যা বর্তমানে বৌদ্ধ চরমপন্থার মহাবিস্ফোরণ দেখছে দেশটি। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিমদের স্বাধীন ধর্মপালনের উপর অনৈতিক হস্তক্ষেপ দেশটির মুসলমানদের প্রতিনিয়ত উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা সরকারের কাছে আইনটি বাতিল আবেদন করেছে। তবে এখনো পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় শ্রীলঙ্কাতে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছাড়া কোন মুসলিম দেশ এখনো এটি নিয়ে মুখ খোলেনি। ওআইসি (OIC), জিসিসি (GCC), তুরস্ক, সৌদি আরব বা ইরানের মত দেশও এখনো আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির সব বিশেষজ্ঞের এক প্রশ্ন তাহলে কি শ্রীলঙ্কাও মিয়ানমারের মত মুসলিমদের জন্য চরম অনিরাপদ হয়ে উঠছে! এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আরো কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা