করোনা উদ্ভূত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা শীর্ষক ভাবনা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক সভ্যতার প্রধান ভিত্তি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি একদিকে যেমন ধীরগতি, অন্যদিকে তেমনই সুদূরপ্রসারী। ইউনিসেফের “Global monitoring of school closures” এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ১১২টি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান পদ্ধতি চালু আছে, ৪০টি দেশ তাদের শিক্ষা-কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু রেখেছে। মাত্র ২৭টি দেশ দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা-কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যায়নি। তাঁরা শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা দূরশিক্ষণ ও অনলাইন মাধ্যমে অব্যাহত রেখেছে।
করোনাভাইরাস মহামারিকালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি।
উচ্চ মাধ্যমিকেও খুব একটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় নি। ২০২০ এইচএসসি ব্যাচকে অটোপাস, ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসিও সে পথেই হাঁটছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার নাজুকতা, আগামীর একটা ভঙ্গুর জাতি ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রতিক্ষণে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের দোয়ারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি সমানহারে। সেমিস্টার পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় সকল বিভাগের একাধিক সেমিস্টারের পাঠদান সম্পন্ন করে ফেললেও পরীক্ষা পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট কোন উত্তম পন্থা নিশ্চিত করতে পারেনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা দায়সারা ভাবে যে মূল্যায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তা যথেষ্ট প্রশ্ন রাখে। এতে করে আদৌ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাত্মা উপলব্ধি করে একটা আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে কিনা, সেই শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যবস্থা অচলায়তনের কাছাকাছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অতীতের জটিলতা ক্রমশ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। দেশের কারিগরি, উন্মুক্ত, পলিটেকনিক শিক্ষা ব্যবস্থার স্থবিরতা আগামীর অদক্ষ প্রজন্মের ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রতিক্ষণে।
আপাত দৃষ্টিতে শিক্ষা ব্যবস্থার এই ভয়াবহ স্থবিরতার আঁচ অনুভব করতে না পারলেও, অদূর ভবিষ্যতে এটার নেতিবাচকতার প্রভাব পরবে প্রতিটা জাতীয় ইস্যুতে এবং তা অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি হবে।
করোনা সঙ্কট অতিদ্রুত আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না তা সকল বিশেষজ্ঞ মহল কর্তৃক স্বীকৃত। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত বন্ধ রয়েছে, তা আরও অনিশ্চিতভাবে বন্ধ রেখে কোন সমাধান হবে বলে মনে হয়না। অবশ্যই করোনা যুদ্ধ মোকাবেলার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার অচলায়তন রোধকল্পে আমাদের কার্যকরী মনোভাবের সাথে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিশ্চিত করা উচিত। প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিত, নতুন কর্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত।
মোদ্দা কথা শিক্ষা ব্যবস্থা অতি স্বত্বর স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা উচিত। তা না হলে, করোনার ছোবলের চেয়ে বহুলাংশে বড় বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে শিক্ষা ব্যবস্থার অচলায়তনের প্রভাব।
করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আরো আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক আর অবশ্যই সবার সাধ্যের মধ্যে আনা হোক।
এ অবস্থায় চলমান মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতে শিক্ষায় ব্যাপক সংস্কারের পক্ষে এখনই ভাবতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও জাতীয় পাঠ্যক্রম সংস্কারের উদ্যোগের কথা জানা যাচ্ছে। তবে অন্যান্য অনেক ব্যবস্থার সাথে শিক্ষা পদ্ধতিকে গুলিয়ে ফেলে ক্রমশ মন্থর করে ফেললে তার ফল বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, সিডিসির তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যক্ষ্মায় ইউরোপ আর আমেরিকায় মারা যেত প্রতি সাতজনে একজন। যক্ষ্মার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয় ১৯২১ সালে। সেই প্রতিষেধক বিশ্বের সব দেশের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে যায় আরও বেশ কিছু বছর। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চারা যাতে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে তার সমাধান হিসাবে জন্ম নেয় খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থা। তা সমসাময়িক সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিকল্প পদ্ধতি ছিলো। এটা ছিলো তখনকার সময়ের জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। ঠিক আমাদেরকেও অবশ্যই এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে যাতে করে করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেও শিক্ষা ব্যবস্থার চলমানতা অব্যাহত থাকে।
সবকিছুই যদি খোলা রাখা যায় তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখেও কীভাবে করোনা মোকাবিলা করা যায় সেই পদক্ষেপ নেওয়াই বোধকরি সময়ের দাবি!
দীর্ঘ ১৪ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে গড়ে না ওঠার ক্ষতি এবং মানসিক ক্ষতি বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তই মনে হয় যুক্তিযুক্ত।
লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।