যেন এমন— তাদের নিয়ে লিখলেই ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে!

ড. এ. এইচ. এম. কামাল
ড. এ. এইচ. এম. কামাল  © টিডিসি ফটো

বেশ কিছুদিন ধরে ক’জন শিক্ষার্থী আমাকে তাদের একটি দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। আমি ফেসবুকে সচেতনামূলক কিছু একটা লিখলেই তারা আমাকে তাদের বিষয়েও লিখতে বলে। তাদের দাবি হচ্ছে, আমি যেন করোনাকালে স্থির হয়ে থাকা তাদের শিক্ষাজীবনে গতি আসার উপায় নিয়ে লিখি।

এমন কি কেউ কেউ আক্রমণও করে। অনেকটা শিশুসুলভ আক্রমণ– আপনি দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, বিশ্ব নিয়ে এত লিখেন, জ্ঞানের কথা বলেন আর আমাদের কথা কিছু বলেন না? অবস্থা যেন আমি লিখলেই তারা এই চলমান স্থবিরতা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। তারা বুঝতে চায় না যে একজনের দ্বারা সব নিয়ে লেখালেখি করা সম্ভব না।

গতরাতেও এক ছাত্রের বিশাল ম্যাসেজ পেলাম। ডিমান্ড একই। আমি যে তাতে বিরক্ত হই না; তা না। আবার যখন এক কৃষক বাবার কথা ভাবী যিনি তার ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন এবং অপেক্ষায় আছেন কবে তার ছেলে অফিস করে দু’পয়সা এনে তার অভাবী সংসারের ছিদ্রগুলো বন্ধ করবে তখন বিচলিত হই। তথাপি একটি দেশের সরকার যখন কোন সিদ্ধান্ত নেয় তার বিপরীতে লেখালেখির আদর্শ আমার নেই।

তবে যতদূর জেনেছি সম্ভবত আগামী ৫ মে সকল উপাচার্যগণ ইউজিসিতে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে একত্র হচ্ছেন। আশা করি এবার তার সুন্দর সমাধান আসবে। কিন্তু এই করোনা বিস্ফোরণমুখী সময়ে শিক্ষার্থীদের হলে, ক্লাসে, পরীক্ষার কক্ষে জমায়েত করানো হবে কিছুটা ঝুঁকির কাজ। আবার স্থবিরতা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন বর্ষেরও পরিবর্তন করা দরকার। কারণ অনেক আগে থেকেই তারা হতাশায় ভুগতে শুরু করেছে।

তাই এ লক্ষ্যে সম্মানিত উপাচার্যগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু বলতে চাই।

১। অর্ডিন্যান্সে যাই থাকুক না কেন সকল শিক্ষাবর্ষের মিড-টার্মগুলোকে অনলাইনে মাধ্যমে সেমিনার/প্রেজেন্টেশন বা এসাইনমেন্ট আকারে গ্রহণ করা যেতে পারে। অথবা গুগল ফর্মের মাধ্যমেও নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বাস করে নিতে হবে যে পরীক্ষার্থী নিজেই পরীক্ষা দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরকেও একই রকম আদর্শবান হতে হবে। তখন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফর্মটি ওপেন করে দিয়ে পরীক্ষার কাজ সমাপ্ত করা যেতে পারে। আরও বেশি নিরাপত্তার জন্য পরীক্ষার্থীর ডিভাইসে ওয়েবক্যাম থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

২। অর্ডিন্যান্সে যাই থাক, এটেন্ডেন্সের নম্বর বাতিল করতে হবে। তার পরিবর্তে একই নম্বরের কোন এসাইনমেন্ট, সেমিনার, প্রোজেক্ট হতে পারে।

৩। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে না পারলে অনলাইনের মাধ্যমে অনেক ল্যাব ক্লাসই পরিচালনা করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে প্রতিটি ইলেক্ট্রনিক্স, কেমিক্যাল বা এ জাতীয় ল্যাবের জন্য প্রচলিত ও ফ্রিতে প্রাপ্তব্য সিমোলেশন সফটওয়ার কি আছে তা জানতে হবে। তা করতে গিয়ে নানা সমালোচনা ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে হয়তো।

একটি ইউনিফর্মিটির জন্য ইউজিসির মাধ্যমে একটি বড় কমিটি করে দেওয়া যেতে পারে যাদের কাজ হবে কোন একটি স্পেসিফিক ল্যাবের জন্য কি কি সিমোলেশন সফটওয়ার ফ্রিতে পাওয়া যায় তা যাচাই করে এক বা দুটি সফটওয়ারের ব্যবহার ফিক্সড করে দেওয়া। তাতে করে এক এক শিক্ষকের এক এক ভাবে পড়ানোর পদ্ধতি দূর হবে।

৪। তারপরেও যদি কোন ল্যাব বা এ ধরনের কোর্স কন্ডাক্ট করা না যায় তবে বিভাগ তার বিভাগের একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে জানান দিতে পারে। তখন সেই সংখ্যক কোর্সের পরীক্ষা ব্যতিরেকে (তবে শিক্ষকের নিজস্ব কায়দায় অনলাইনে শিক্ষার্থীদের থিউওরিটিকেলি জ্ঞান দিয়ে) ডিগ্রী দেবার ব্যবস্থা নিতে হবে। সিজিপিএ হিসাবের ক্ষেত্রেও এ সকল কোর্সের ক্রেডিট-আওয়ার বিবেচনায় নেওয়া হবে না।

৫। প্রোগ্রামিং, ভাইবা বা এ জাতীয় কোর্সের ক্লাস ও পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার সময়ের ব্যাপ্তি কমিয়ে দেড় বা দুই ঘণ্টা করে এবং ওয়েবক্যামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ফেস ও ল্যাপটপ ওয়েবক্যামের ভিডিওতে কভার করে পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে। প্রতি ৫ জন শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক অনলাইনে (জুমের মাধ্যমে) মনিটর করবেন।

৬। থিউরি পরীক্ষাগুলোও শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে উত্তরপত্রের কভার পেজ এবং পরবর্তী পেজের নমুনা হিসাবে একটি পেজ (পরিদর্শকের স্বাক্ষর সম্বলিত) ইমেইলে ৩০ মিনিট আগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে রাখা হবে। নিরাপত্তার জন্য এক এক দিন খাতার এক এক জায়গায় এবং একটু স্টাইল পরিবর্তন করে স্বাক্ষর করবেন যাতে আগের দিনের সাথে হুবুহু মিলে না যায়। অর্থাৎ আগেরদিনের পেজটি কেউ আবার ব্যবহার করতে না পারে, মানে আগেই লিখে না রাখতে পারে। ৩০ মিনিটের ভিতরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কাগজ প্রিন্ট নিতে পারবে এমন ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থীকে নিজে থেকে করে নিতে হবে। অর্থাৎ নিজের প্রিন্টার থাকতে হবে, অথবা প্রিন্ট করার মতো কাছাকাছি পরিবেশে বসে পরীক্ষা দিতে হবে।

তারপর পরীক্ষা শুরুর পাঁচ বা দশ মিনিট আগে প্রত্যেকের কাছে ইমেইলে প্রশ্ন পাঠিয়ে দেওয়া হবে এবং একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েব-সাইটে প্রশ্ন ওপেন করে দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা ওয়েবক্যামের মাধ্যমে নিজের ফেস ও খাতা ভিডিও এর অধীনে রাখবে। প্রতি দশজন শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক জুমের মাধ্যমে মনিটর করবেন। পরীক্ষার সময় কমিয়ে এক বা দেড় ঘণ্টা করা যেতে পারে।

নির্দিষ্ট সময় শেষে শিক্ষার্থীরা ক্যামস্ক্যানার সফটওয়্যার দিয়ে বা যে কোন স্ক্যানার দিয়ে অথবা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে এর পিডিএফ তৈরি করে পরবর্তী ২০মিনিটের ভিতরে নির্দিষ্ট ঠিকানায় সফট-কপি আকারে প্রেরণ করবে। পরিদর্শনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকগণ তা পরীক্ষা কমিটি ও বিভাগীয় প্রধানের সামনে প্রিন্ট, স্বাক্ষর ও প্যাকেজিং করে কন্ট্রোলার দপ্তরে পাঠাবেন। যদি কোন শিক্ষক কেন্দ্রে উপস্থিত হতে না পারেন তবে ওয়েবক্যামের মাধ্যমে সকলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন এবং তখন প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং কাজটি উল্লিখিত সদস্যদের কেউ একজন করবেন। বিভাগীয় প্রধান ও/বা পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান আগেই কাজের সমন্বয় করে দিবেন। তারপর যথা নিয়মে মূল্যায়ন হবে।

৭। যদি কোন কোর্স সম্পন্ন হতে বাকি থাকে তবে বিভাগের একাডেমিক কমিটি ডেডলাইন দিয়ে কোর্স সমাপ্তির উদ্যোগ নিবেন। একই সাথে উপরোক্ত পদ্ধতিতে পরীক্ষার আয়োজন করবেন।

৮। পরীক্ষার ফি ও বেতন অনলাইনে (বিকাশ/নগদ/ব্যাংক) গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে।

৯। ফরম পূরণের জন্যও অনলাইন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ওয়েব-ফর্ম তৈরি করে নিতে হবে। ওয়েব ফর্ম ডেভেলপমেন্টের ঝামেলা এড়াতে চাইলে গুগল ফর্মেও তা করে নেওয়া সম্ভব। আবার ইউজিসি চাইলে ৭ এবং ৮ নং এর কাজটি করে দেওয়ার জন্য তারা একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। অর্থাৎ তাদের তৈরি এক সফটওয়ারে সকল বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করবে।

আশা করি আমাদের উপাচার্য মহোদয়গণ এর চেয়েও ভাল কোন সমাধান নিয়ে আসবেন। তথাপি তাঁরা যদি আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের কথা গুলি পড়ে দেখেন তাহলে উপকারেও আসতে পারে। করোনা হতে সকলে মুক্ত থাকুক এবং আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের হতাশা দূরীকরণে কোন ভাল সমাধান আসুক সেই প্রার্থনা করি। সবাই সাবধানে থাকবেন।

লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়