৩০ এপ্রিল ২০২১, ০৮:২৩

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধ: প্রত্যাশা বনাম সফলতা

রায়হান ইসলাম  © টিডিসি ফটো

উচ্চ মাধ্যমিকের পরে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত এক স্বপ্নের নাম দেশের পাবলিক কোন বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে দানা বাঁধতে শুরু করে এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা। কাঙ্ক্ষিত ক্যাম্পাসে বিচরণের স্বপ্ন যেমন শিক্ষার্থীদের শিহরিত করে, তেমনি অজানা শঙ্কা কেঁড়ে নেয় চোখের ঘুম। ফলে সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে নিজের আত্মবিশ্বাসকে হারিয়ে অনেকে ব্যর্থতাকে বরণ করায় জীবন থেকে হারিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্ন। আবার অনেকে একটু হোঁচট খেতেই সাহস হারিয়ে পিছু হটতে শুরু করে, কেউ বদলে ফেলে তাদের জীবনের লক্ষ্য। যার ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশায় ভাঁটা পড়ে ব্যর্থতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় অনেক শিক্ষার্থীর সফলতার সেই গল্প!

আজকে লেখাটি সেই সব শিক্ষার্থীর জন্য যারা সফলতা প্রত্যাশী। যাদের প্রত্যাশা দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করা এবং তার জন্য তারা প্রতিনিয়ত দৃঢ় প্রত্যয়ে সংগ্রাম করে চলেছে। যাতে দেশের স্বনামধন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পদার্পণের মাধ্যমে নিজের কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্ন পূরণ করবে বলে।

আজ শুরুটা বিখ্যাত লেখক কোকো চ্যানেলের উদ্ধৃতি মাধ্যমেই করতে চাই। যিনি বলেছিলেন, “বেশির ভাগ সফলতা তাদের দ্বারা অর্জিত হয়, যারা ব্যর্থতার কথা ভুলে লক্ষ্য অর্জনে ছুটে চলে।” কেননা, আর্নল্ড গ্লাসগো বলেছেন, “সাফল্যের আগুন একা একা জ্বলে না। এটাকে নিজের হাতে জ্বালাতে হয়।”

সুতরাং নিজেকে এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে লক্ষ্য জয়ের সংগ্রামে পরাজিত হতে না হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “একটি লক্ষ্য ঠিক করো। সেই লক্ষ্যকে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলো। চিন্তা করো, স্বপ্ন দেখো। তোমার মস্তিষ্ক, পেশী, রক্তনালী - পুরো শরীরে সেই লক্ষ্যকে ছড়িয়ে দাও, আর বাকি সবকিছু ভুলে যাও। এটাই সাফল্যের পথ।”

লক্ষ্য জয়ের প্রত্যাশা নিয়ে যারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখে, সফলতা তাদের কাছে অলিক বস্তুর ন্যায়। তাই পাবলো পিকাসোর ভাষায়, “সঠিক সময়ে কাজ শুরু করাই হলো সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।” আমেরিকার বিখ্যাত লেখক ফ্রাঙ্ক লয়েড বলেছেন, “সাফল্যের জন্য তোমাকে ৩টি মূল্য দিতে হবে: ভালোবাসা, কঠোর পরিশ্রম, আর স্বপ্নকে বাস্তব হতে দেখার জন্য ব্যর্থতার পরও কাজ করে যাওয়া।”

সুতরাং, যার মাঝে সীমাহীন উ‌ৎসাহ, বুদ্ধি ও একটানা কাজ করার গুণ থাকে, তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। কেননা “সফল মানুষের সাথে অসফল মানুষের প্রধান পার্থক্য শক্তি বা জ্ঞানে নয়। পার্থক্যটা হলো সত্যিকার সফল হওয়ার ইচ্ছা।”
-ভিন্স লম্বারডি, আমেরিকান ফুটবলার ও কোচ।

প্রত্যেক সফল মানুষের পিছনে লুকিয়ে থাকে কোন না কোন ব্যর্থতার গল্প। যারা সেটাকে পুঁজি করে সফলতা নামক বস্তুটির সন্ধান পেয়েছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। তিনি বলেছেন, “আমি বলব না, আমি ১০০০ বার ব্যর্থ হয়েছি। বরং বলব, আমি ১০০০টা পথ আবিষ্কার করেছি। যেখানে কোন সফলতা নেই।” আর আজ তিনি একাই ১০০০ এরও বেশি আবিষ্কারের জনক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনীর জেনারেল জর্জ এস. প্যাটন বলেছিলেন,“একজন মানুষ এখন কতটা উপরে আছে, তা দিয়ে আমি তার সাফল্য মাপি না। একদম নিচে পড়ে যাওয়ার পর সে নিজেকে কতটা ওপরে তুলতে পারে- সেটাই আসল কথা।”

অনেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে অতি উৎসাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রস্তুতি শুরু করে। আবার কোন কারণ বসত মাধ্যমিকে ফলাফল একটু খারাপ হলে দুঃখ-কষ্ট-হতাশায় বিষণ্ণ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। মনে করতে থাকে তাকে দিয়ে আর কিছু হবে না, সে আর কোন কিছুর যোগ্য না। অথচ প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থী দেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, যাদের ফলাফল খুব ভালো ছিল না। সুতরাং নিজের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতাকে অন্তরায় ভাবা উচিত না।

অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারলে কিংবা সেখানে প্রত্যাশিত বিষয় না পেলে দুঃখ-কষ্ট হাহুতাশ করতে থাকে অনেক শিক্ষার্থী। আবার সেই হতাশায় কেউ জীবনের গতিপথই বদলে ফেলেন। অথচ বিখ্যাত সুফি ও মনিষী জালালুদ্দিন রুমির একটি দৃষ্টান্তে আমরা দেখি- একদিন জালালুদ্দিন রুমি নিজ গৃহে ইবাদত শেষে রবের নিকট করুন স্বরে বলেছিলেন-হে রব আমাকে এতোই গরিব করে সৃষ্টি করলে যে চলার পথে পায়ে পরব এমন কোন জুতাও নেই। কিছুক্ষণ পরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলে পথিমধ্যে রাস্তায় তিনি এমন একটি মানুষ দেখতে পেলেন, যার দুটি পা-ই নেই!

তিনি অবাক হলেন এবং কালবিলম্ব না করে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে রবের নিকট শুকরিয়া আদায় করে বললেন- হে রব, হাজারো শুকরিয়া তোমার প্রতি। আমি অনেক সুখি। আমি আর কিছু চাই না। তুমি তো আমাকে দুটি পা দিয়েছে। যা দিয়ে ইচ্ছে করলেই দেশান্তরে বিচরণ করতে পারছি। আমাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। শুকরিয়া, হে রব্বুল আলামীন।

জৈনক এক মনিষী বলেছেন, “যে জীবনে প্রত্যাশা যত কম, সুখ সেখানে ততো নিকটবর্তী এবং সফলতা দ্বার সহজ।”

সফলতা সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত লেখক ও মোটিভেটর ডেল কার্নেগী বলেছেন, “ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের প্রাসাদ গড়ো। হতাশা আর ব্যর্থতা হলো সাফল্যের প্রাসাদের দুই মূল ভিত্তি।” কেননা, “সাফল্য একটি বিজ্ঞান। যেখানে সঠিক উপাদান মেশালে সঠিক ফলাফল তুমি পাবেই”- অস্কার ওয়াইল্ড। তাই মার্ক টোয়েন বলেছেন,“জীবনে সফল হতে চাইলে দু’টি জিনিস প্রয়োজন: জেদ আর আত্মবিশ্বাস।”

তবে জীবনে সফল হওয়া অপেক্ষা দক্ষ হওয়া বেশি কার্যকরী। কেননা, এই দক্ষতা একদিন ব্যক্তিকে সফল করে তুলবে। তাই, বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, “সফল হওয়ার চেষ্টা করার বদলে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করো। সাফল্য এমনিই আসবে।” আর সেজন্যই মনে হয় চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতা মাও সে তুং বলেছিলেন, “সন্তানের সাফল্য চাইলে তাকে মাছ খেতে দেয়ার বদলে মাছ ধরতে শেখাও।”

বিশ্বে সফল মানুষের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তি আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা সফল হওয়ার করণীয় সম্পর্কে বলেছেন, “অতীতের সাফল্য হয়তো তোমাকে ভবিষ্যতের ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি যদি প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে পারো, তবে দিন শেষে তুমি একজন সফল হবেই।” কেননা, “রাতারাতি সাফল্য বলতে কিছু নেই। মনোযোগ দিয়ে কাজ করো দেখবে দেরিতে হলেও সাফল্য আসবেই”- স্টিভ জবস।

তবে মনে রাখতে হবে, সাফল্য অর্জন করা আর সফল হওয়া এক নয়। সুবিধা পেলে অনেকেই সফল হতে পারে। অনেককে জোর করে সফল বানানো যায়। কিন্তু যে নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রম করে সফল হয়-সেই প্রকৃত সফল। তাই ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক ডেভিড ফ্রস্ট বলেন, “সাফল্য চাইলে সাফল্যকে লক্ষ্য বানিও না; তুমি যা করতে ভালোবাসো, সেটাই করতে থাকো। একদিন সাফল্য নিজেই ধরা দেবে।”

যে কাজে ভালোবাসা নেই, প্রাপ্তি সেখানে অর্থহীন, আর সফলতা মূল্যহীন। আবার অধিক প্রত্যাশা জীবনের সুখি মূহুর্তগুলো নষ্ট করে, আর অসুখী জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতার কষাঘাত। অতএব, সফলতা পেতে অধিক প্রত্যাশার ব্যতিরেখে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রত্যাশা অধিক বাঞ্ছনীয়।

সুতরাং, হতাশ না হয়ে প্রত্যাশিত পথে সর্বদা দৃঢ় বিশ্বাসে এগিয়ে গেলেই সফলতার দেখা পাওয়া সম্ভব। কেননা, আল্লাহ কাউকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না। তাই, পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- “তোমরা হতাশ হইয়ো না, দুঃখ করো না। তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।”

লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়