চেয়ারম্যানদের হুটহাট বদলি, এনটিআরসিএ’র স্থবিরতা

মো. সান্ত আলী
মো. সান্ত আলী  © ফাইল ফটো

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) সারাদেশের সকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করে থাকে। যা সত্যিই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলক্ষেত্রে বেশ প্রসংশিত হচ্ছে। তবে, নিয়োগ বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ ও অন্যান্য আইনগত জটিলতার কারনে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বারবার স্থবির হয়েছে। যা উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে যেমন ক্ষতি করেছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নিয়োগ প্রত্যাশী নিবন্ধনধারীদের। কারন তারা এনটিআরসিএ এর অধীনে শিক্ষক হবার সনদ নিয়ে মাসের পর মাস নানা দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় সময় পার করছে। অনেকের আবার অপেক্ষা করতে করতে বয়সও শেষ হয়ে গেছে। শিক্ষক হওয়ার লালিত স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।

কার্যক্রমে স্থবিরতা ও ভোগান্তির কারন হিসেবে অন্যতম প্রধান হচ্ছে, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতার অভাব, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে চেয়ারম্যানদের হুটহাট বদলী, চেয়ারম্যানদের যোগদানে অনিচ্ছা, মামলায় জর্জরিত হওয়ার ভয়, যোগদান করলেও স্বল্প সময় অবস্থান এবং সুদূরপ্রসারী কার্যকরী পরিকল্পনার অভাব। এর ফলে একটি নিয়োগ কার্যক্রম শুরু ও শেষ করতেই কয়েকবছর লেগে যাচ্ছে। যা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা লাখো বেকারদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যা করোনাকালী বেকারত্ব থেকে স্বস্তি ও শিক্ষাক্ষেত্রের নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণে অন্যতম অন্তরায়।

২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তাকে এনটিআরসিএ এর চেয়ারম্যান হিসেবে বদলি করে আদেশ জারি করা হয়। তিন সপ্তাহের নাটকীয়তার পরে ১৬ অক্টোবর পুনরায় এস এম আশফাক হোসেনকে এনটিআরসিএ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অবসরজনিত কারনে ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে আশফাক হোসেন বিদায় নিলে ২৯ জানুয়ারী ২০২০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. অরুনা বিশ্বাসকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু তিনি আর যোগদান করলেন না।

২০২০ সালের গত ৫ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে আকরাম হোসেনকে এনটিআরসিএ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিও বেশি দিন থাকলেন না। কয়েকমাস পরেই অবসরে চলে যান। অবশেষে, ২০২০ সালের ১৪ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আশরাফ উদ্দীনকে এনটিআরসিএ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারও বেশি দিন থাকার হয়তো সম্ভব হবে না। কারন, গত ২২ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তারও বদলী আদেশ জারী করে।

চেয়ারম্যান হিসেবে আশফাক হোসেন যথেষ্ট সময় পেয়েছে ও তার আন্তরিকার জন্য এনটিআরসিএ অত্যন্ত দক্ষ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রুপান্তিরত হয়ে উঠে। যা নিবন্ধনধারী সকলেই মন থেকে বিশ্বাস করে এবং তার সুফলও সকলেই পাওয়া শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে শুধু চেয়ারম্যানের বদলী ও নিয়োগেই হয়েছে কাজের কোন কাজ হয়নি। আইনগত জটিলতা, নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে কোনরকম তৎপরতা দেখা যায়নি। ঝুলে যায় নিয়োগ কার্যক্রম।

কিন্তু, মো. আশরাফ উদ্দীন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করা, আইনগত জটিলতা নিরসনে যথেষ্ট দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে বেশ তৎপর হয়ে কাজ শুরু করেন। তার ফলে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষকের পুনরায় সুপারিশ, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ৫৪ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। ইতোমধ্যে ৫৪ হাজার শুণ্যপদের বিপরীতে প্রায় ৭০ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছে এনটিআরসিএতে। তাছাড়া, এই বছরে প্রায় এক লক্ষ শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে প্রতিষ্ঠানটি। তার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

বর্তমান চেয়ারম্যানের আবারও হুট করে বদলির আদেশ সমগ্র নিয়োগ কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন জটিলতা ও নিবন্ধনধারীদের নানা শঙ্কা ও দুশ্চিন্তাকে জিয়ে রাখলো। এক্ষেত্রে, সরকারের উচ্চ মহল বিশেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভাবা উচিত, চলমান নিয়োগ কার্যক্রমে প্রায় ৭০ লক্ষ আবেদনকারীর বিরাট একটি কর্মযজ্ঞ চলমান থাকা অবস্থায় একজন চেয়ারম্যানকে বদলী কতটা সমীচিন হবে। তাছাড়া, অনেক আইনি জটিলতা সমাধানের চলমান প্রক্রিয়াও তো বাধাগ্রস্থ হবে।

যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত এই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি কার্যক্রমের সাথে উচ্চ শিক্ষিত লক্ষাধিক বেকার ও তাদের পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তাছাড়া বর্তমান সরকারের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও এর সাথে সম্পৃক্ত। এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় যাতে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থবির হয় এবং সরকারের কোন মহৎ কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। আমি ও আমরা সাধারণ নিবন্ধনধারীরা মন থেকে আশা করি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই বিষয়টি সুনজরে নিয়ে এনটিআরসিএ এর কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখতে ও চলমান নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা সহ যাবতীয় জটিলতা সমাধানে বর্তমান চেয়ারম্যানকে আরো কিছুদিন স্বপদে বহাল রাখবেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এনটিআরসিএ এর চলমান কার্যক্রম জাতীয় বৃহৎ স্বার্থ ও শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। যা শিক্ষা, সমাজ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম এক মানদন্ডও হবে বটে।


লেখক: এনটিআরসিএ নিবন্ধিত প্রভাষক (১৫তম)


সর্বশেষ সংবাদ