মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ও আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ
- মো. হাসান তারেক
- প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১০:১৮ AM , আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১০:১৮ AM
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তার দেশের সৈন্যদের প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন। বুধবার তিনি এই ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাস্তবে রূপ নিলে মার্কিন ইতিহাসের দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কুড়ি বছর আগের এই ১১ সেপ্টেম্বর দিনটিতেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রান্ত হয়েছিল। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সোজা বিমান ঢুকিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন শক্তিশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল কায়েদা। এই হামলার পর আমেরিকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসাবে মার্কিন সেনাদের অদ্যাবধি আফগানিস্তানে অবস্থান।
আফগানিস্তানে আমেরিকার নেতৃত্বে সামরিক জোটের প্রায় নয় হাজার ৬০০ সেনা আছে। যার মধ্যে মার্কিন সেনা আড়াই হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সামরিক জোট ন্যাটোও সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এই সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আফগানিস্তানে শান্তি না সংঘাতের সৃষ্টি করবে?
এই প্রশ্নের উত্তর বেশ কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের এই দীর্ঘ যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আফগানিস্তানে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪৮ জন সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। আমেরিকার খরচ হয়েছে প্রায় ২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। চতুর্থতম প্রেসিডেন্ট হিসাবে জো বাইডেন আফগানিস্তান সংকট মোকাবিলা করছেন। একারণে জো বাইডেন চাইছেন আফগানিস্তান থেকে সরে এসে অন্যান্য নতুন সঙ্কটগুলো সমাধানে ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে।
আমেরিকার সামনে এখন করোনা মহামারি মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ চীন ও রাশিয়ার মত প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করার মত বিষয় রয়েছে। আমেরিকার জন্য সাময়িকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তান থেকে সরে আসা হয়তবা সঠিক সিদ্ধান্ত নাও হতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে। ১৯৮৯ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সরে আসল তারপরে উত্থান ঘটে তালেবান ও আল-কায়েদার। যৌক্তিক সমাধানে উপনীত না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে সরে আসা অনেকটা সেই রকম যেন না হয়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ানও অনুরূপ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, ‘আফগানিস্তানের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল ও ভয়ানক।’
আফগান নিরাপত্তা বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের উপর আর্থিক ও সামরিক বিষয়ে নির্ভরশীল এবং তাদের ছাড়া তারা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। তালেবানদের পাশাপাশি তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএসও এখন আফগানিস্তানে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একারণে আফগান ও তালেবানদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ছাড়া মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার শুধু আফগানিস্তানে নয় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে তালেবানরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, বিদেশি সেনা পুরোপুরিভাবে প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তারা সমঝোতায় যাবে না। তাদের এই হুশিয়ারি আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক করে। যেখানে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১লা মের মধ্যে সেনা সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেখানে জো বাইডেনের এই নতুন সিদ্ধান্তে তালেবানদের প্রতিক্রিয়া আশাব্যঞ্জক নয়।
তালেবানরা বলছে, দেশ থেকে সব সেনা না চলে গেলে তারা ২৪ এপ্রিল থেকে তুরস্কে শুরু হতে যাওয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবে না। তবে আয়োজকরা আশাবাদী সম্মেলনের বিষয়ে। কিন্তু নামমাত্র সম্মেলন হলে হবে না। সম্মেলনে আফগান ও তালেবানদের মধ্যে কার্যকর, ফলপ্রসূ সমঝোতায় উপনীত হতে হবে।
সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার গঠনসহ শান্তি, স্থিতিশীলতা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করলেও তাদেরকে এই শান্তি প্রক্রিয়া তদারকির জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে আফগানিস্তানে চীন ও রাশিয়ার মত যে দেশগুলোর সুযোগ সৃষ্টি হবে তাদেরকে এই সুযোগ ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। গত দুই দশকে নারী অধিকারসহ, মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা রক্ষার মত যেসকল বিষয়ে সফলতা এসেছে তা বজায় রাখার জন্য পরবর্তী প্রশাসন ও জনগণকে উৎসাহী করতে হবে।
সর্বোপরি, আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোকে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, স্থিতিশীল আফগানিস্তান, স্থিতিশীল এশিয়া ও বিশ্বের জন্য অত্যাবশ্যক। নতুবা আইএস ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হলে হিতে-বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।