শিক্ষা ও ঐতিহ্যে বাংলা নববর্ষ

  © প্রতীকী ছবি

বছর ঘুরে প্রতিবারই আমাদের কাছে আগমনী বার্তা নিয়ে প্রতিভাত হয় বাংলা নববর্ষ।  এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি যদিও, আবির্ভাবের মুহুর্ত ও রুপায়ণ চিত্রে রয়েছে ব্যাপক ভিন্নতা। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রাণনাশী দ্বিতীয় আগ্রাসনে বাঙালী জাতি যেখানে বিপর্যস্ত এবং জীবন জীবিকা অন্বেষায় দিশেহারা, তেমনি একটি ভয়াবহ মুহুর্তে আবির্ভূত হয়েছে ১৪২৮ সাল; এবারের বাংলা নববর্ষ। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় যখন একেবারেই বন্ধ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নেই কোন আনাগোনা, প্রাণেরও নেই কোন উচ্ছ্বাস এবং জনমনেও রয়েছে চরম আতংক, এমন একটি পরিবেশে এবারের বাংলা নববর্ষের প্রত্যাশিত উদযাপন নিয়ে সর্বমহলে রয়েছে নানা উৎকন্ঠা।

তদুপরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও অনলাইনে যেহেতু শিক্ষা-কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে, নববর্ষের আনন্দ-আবেশের বিচ্ছুরণ ঘটানোর একটি প্রয়াস নেয়া যেতেই পারে। কারণ, বাংলা নববর্ষ আমাদের শিক্ষা ও ঐতিহ্যের এক সুহৃদ বন্ধন। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকে এ নববর্ষের প্রতিটি স্মৃতি ও আবেগ মিশ্রিত অনুভূতি। 

মানব সভ্যতার ইতিহাসে নববর্ষ উদযাপিত হয় যে কোন বছরের প্রথম দিনে এবং এ দিন থেকেই বৎসরিক  ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জির দিন গণনা শুরু হয়। জাতি ও ভাষা ভেদে বর্ষপঞ্জির সন, মাস ও দিনক্ষণ ভিন্ন হতে পারে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বর্ষপঞ্জি হল গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, আর তাতে নতুন বছর শুরু হয় জানুয়ারির ১ তারিখে (নতুন বছরের দিন)। রোমান বর্ষপঞ্জি (কমপক্ষে ৭১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) এবং জুলীয় বর্ষপঞ্জি উভয় ক্ষেত্রে এটি একই ছিল।

মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলিতে যখন জুলীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করা হত, বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়র উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ গণনা করা হত; যেমন ১ মার্চ, ২৫ মার্চ, ১ সেপ্টেম্বর, ২৫ ডিসেম্বর। ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী চালু করা হয় এবং পুরাতন পদ্ধতি ও নতুন পদ্ধতির তারিখগুলোতে যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয় যার ফলে নতুন বছরের জন্য বিভিন্ন স্থানীয় তারিখের বদলে একটি নির্দিষ্ট তারিখ (১ জানুয়ারি) প্রবর্তিত হয়।

বিশ্বসভ্যতায় পৃথিবীতে প্রধান যে বর্ষপঞ্জির ব্যবহার বহুল প্রসিদ্ধ তম্মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  সেগুলো হলো; ইংরেজি বর্ষপঞ্জি,  হিজরী বর্ষপঞ্জি ও বাংলা বর্ষপঞ্জি। গ্রেগরীয় ও জুলীয় বর্ষপঞ্জির সর্বাধুনিক রুপ হলো ইংরেজী বর্ষপঞ্জি যার সমাপ্তি ঘটে ৩১ ডিসেম্বর থার্টি-ফাস্ট নাইট উদযাপনের মধ্য দিয়ে এবং সূচনা হয় পহেলা জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে। হিজরি নববর্ষের সমাপ্তি হয় জিলহজ্জ মাসের শেষ দিনের মাধ্যমে এবং সূচনা হয় মহরম মাসের প্রথম দিন দিয়ে। এ বর্ষপঞ্জির সমাপ্তি দিনটি থাকে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত, কারণ হিজরি সনের মাসগুলির কোনটি শেষ হয় ২৯ তারিখে আবার কোনটি হয় ৩০ তারিখে, যা সম্পুর্ণ চাঁদের উদয়-অস্তের সাথে সংশ্লিষ্ট।

অনুরুপভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও অনেকটা আরবি বা হিজরি সনের মতই মাসের শুরু ও শেষ হয়ে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় বাংলা সনের মূল কাঠামো শুরু হয়েছিল হিজরি সনকে ভিত্তি করে। কালের অনন্ত প্রবাহের একটি করে নতুন দিনের উদয় হয় আর একটি দিন হারিয়ে যায়। পৃথিবী তার মেরুরেখার ওপর একবার ঘুরপাক খেলে সম্পূর্ণ হয় একটি দিন-রাত। এমনি দিন-রাতের মালা গেঁথে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ ইত্যাদি ঋতু পরিক্রমা শেষ করে ঘুরে আসে এক একটি বছর। আসে নতুন বছর, আসে বৈশাখ আর উদযাপিত হয় নববর্ষ।

সম্রাট আকবরের রাজত্বের চল্লিশতম বছরে ওই সালটির ১৫১৭ অব্দ চলছিল। এই প্রাচীন সালটিই আমাদের বর্তমান বাংলা সনের উৎস। জ্যোতিষী গণনায় যে সম্পর্ক যুক্ত হয়েছিল তার প্রতিটি মাসের নামেই রাখা হয়েছিল এক একটি নক্ষত্রের নামে। যে নক্ষত্রে পূর্ণিমার অস্ত হয়, সে নক্ষত্রের নামানুসারেই প্রতিটি মাসের নামকরণ রাখা হয়। আর বিশাখা নক্ষত্রযুক্ত মাসের নাম হয়েছিল ‘বৈশাখ’। জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের সঙ্গেই নববর্ষের উৎসব জড়িত নয়। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি  জীবনে জড়িয়ে পড়ে ওতপ্রোতভাবে।

পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ঐতিহ্য। এটি এমন একটি ঐতিহ্য, যার বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই। গোড়ায় কোনো সুনির্দিষ্ট বছরের সঙ্গেও এর কোনো যোগ ছিল বলে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে ‘নববর্ষ’ একটি  নির্দিষ্ট উৎসবের দিন। বাঙালির ঐতিহ্যের স্মারক। বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে চিরায়ত হয়ে ধরা পড়ে বৈশাখী মেলা, পহেলা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠান। এটি ব্যবসায়ী শ্রেণীর কাছে একটি আচরণীয় রীতি। আর গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যেবেলায় লোকজ ছড়া কেটে কেটে হতো আগুন মশাল উৎসব;

‘ভালা আইয়ে বোড়া যায়,

মশা-মাছির মুখ পুড়া যায়।’ 

বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইতিহাসে উৎসবরূপে পালিত হতে থাকে বাংলা নববর্ষ আর রচিত হতে থাকে অসংখ্য গল্প, কবিতা, গান এই বৈশাখ আর নববর্ষকে নিয়ে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্য বৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির এক প্রাণের উৎসব; প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা। নববর্ষ আদিম মানবগোষ্ঠীর কাছে ছিল সিজন্যাল ফেস্টিভ্যাল এবং নববর্ষ হিসেবে ‘পয়লা বৈশাখ’ সভ্য মানুষের কৃষুৎসব বা এগ্রিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য গুহাচিত্র।

বাংলা নববর্ষ এ দেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সংগীত, নৃত্য, আমোদ-প্রমোদ, পানাহার প্রভৃতি পৃথিবীর যেকোনো প্রাচীন ও নবীন উৎসবের একটি অতি সাধারণ অঙ্গ। আমাদের অধুনা নববর্ষ এদেশের গ্রীষ্মকালীন আর্তব-উৎসব, কৃষুৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নতুন সংস্করণ। এর ঐতিহ্য প্রাচীন, কিন্তু রূপ নতুন। নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে এতে সৃষ্টি করেছে এক নতুন আবহ, নতুন এক সাহিত্যধারা। আর নতুন আবির্ভূত, নবজীবন জাগরিত, সুন্দর সুস্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত। আর কালবৈশাখী এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ-সহচর, নবসৃষ্টির অগ্রদূত, সুন্দরের অগ্রপথিক ও নতুনের বিজয় কেতন। ছন্দের গীতিতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কালবৈশাখী দেখে গেয়ে উঠেন;

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,

তোরা সব জয়ধ্বনি কর—

ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর। ’

পয়লা বৈশাখ সব বাঙালিরই জন্মদিন। সময়েরও যে প্রাণ আছে, সেই প্রাণ যে মানুষের মিলনমেলায় চঞ্চল হয়ে ওঠে, সব ভেদ-বুদ্ধির আবরণ ভেঙে উষ্ণ সেই প্রাণের ছোঁয়া যে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-নির্বিশেষে সবাইকেই উদার ও বিকশিত আহবান জানায়। সে কথাটি পহেলা বৈশাখের ভোরেই ভালোভাবে অনুভব করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩০ সনের পহেলা বৈশাখে শান্তিনিকেতনে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন;

‘...নতুন যুগের বাণী এই যে,

তোমার অবলোকের আবরণ খোলো, হে মানব,

আপন উদার রূপ প্রকাশ কর। ’

[রবীন্দ্র রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬১]

বাঙালির লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সমন্বিত অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রকাশিত হয় বৈশাখের মেলাকে ঘিরে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন;

‘...প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী, কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ...। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্তৃত হয়— তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভারে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা...। ’

এসব মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। গাঁয়ের বধূর ঝোঁক আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-জলেভাসা সাবান, ঘর-গেরস্থালির টুকিটাকি জিনিসের প্রতি। আকর্ষণ তার যাত্রা বা সার্কাসের প্রতিও। আর শিশু-কিশোরের টান তো মূলত খেলনার দিকেই। মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ, মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমা-খাগরাই, জিলিপি-রসগোল্লা। সবই চাই। সবার ওপরে ‘তালপাতার এক বাঁশি’—

‘সবার চেয়ে আনন্দময়

ওই মেয়েটির হাসি,

এক পয়সায় কিনেছে ও

তালপাতার এক বাঁশি। ’

বৈশাখ তার রুদ্ররূপ নিয়ে আবির্ভূত হলেও তার মধ্যে একটা প্রশান্ত মায়া আত্মগোপন করে থাকে, যা মানুষ দু’হাত প্রসারিত করে বিপুল বৈভবের আনন্দে জীবনের আনন্দের সঙ্গে মিশিয়ে নেয় একটি বছরের নতুন প্রত্যাশার আনন্দে।

বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানুষের গ্রামীণ জীবনের যে রূপ-রস মাধুর্যতার ছবি ফুটে উঠেছে, তা সত্যিই অতুলনীয়। এ দেশের কৃষকের আঙিনা যখন বৈশাখে নতুন শস্যের সুগন্ধে ভরে যায়, তখন তার দোলাও লাগে মনের মধ্যে। কৃষকবধূ আঁটি বেঁধে দাহন সাজিয়ে রাখে আর সারা মুখে আনন্দ ছড়িয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানে দিন-রাত। নতুন চাল দিয়ে বাড়িতে তৈরি হয় পিঠে আর ক্ষীর। নতুন অন্নকে বছরের প্রথমে বরণ করার জন্যই জীবনের এই ছোট উৎসব। কৃষক আর কৃষকবধূ অপেক্ষা করে এ দিনের জন্য। সুগন্ধি তেল দিয়ে কৃষকবধূ তার খোঁপা বাঁধে। খোঁপায় রঙিন ফিতে জড়িয়ে হাতে পরে কাচের চুড়ি। চায়ের দোকানে আড্ডা বসে— নাগরদোলায় চড়ে শিশুরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। পুতুলনাচ দেখে সবাই চমৎকৃত হয়ে হাততালি দেয়।

জীবনের এই টুকরো আনন্দের মধ্যে ধরা পড়ে রূপ-বৈভবের চেতনামিশ্রিত নতুন অনুভবের উল্লাস। এ রূপ চিরন্তন, এ রূপ জন্ম দেয় এ দেশের সংস্কৃতির, যা মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বর্ষ শেষে চৈত্র বিদায় নেয় আকাশে কালো পুঞ্জমেঘ বিস্তার করে। সে মেঘে কখনো আকাশ আবৃত হয়ে যায় মেঘলায়; কিন্তু মানুষের জীবনে প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না।

‘বর্ষশেষ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

‘ধাও গান, প্রাণ-ভরা ঝড়ের মতন ঊর্ধ্ববেগে

অনন্ত আকাশে।

উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা

বিপুল নিশ্বাসে।

হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি

পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে—

ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত-আঘাতে

উড়ে হোক ক্ষয়

ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত

নিষ্ফল সঞ্চয়। ’

একটি বছরের নিরাশা আর বেদনাকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে চায় বৈশাখের ঝড়ে দূরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়। নববর্ষ মানুষকে দেয় আশা আর পরিতৃপ্তির কামনা, মন বারবার বলে ওঠে—

‘ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ

ভাঙিয়া মধ্যাহ্ন তন্দ্রা জাগি উঠে বাহির ধারে।’

বাংলা কাব্য-সাহিত্যে যোগ হয়েছে বৈশাখী পালনের নানান গান, কবিতা ও গল্পের আখ্যান। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও নানা পালাবদলের মাত্রিকতায় নববর্ষে একটি মৌলিক ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। তাহলো নবজন্ম, পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরনো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। ইংরেজ কবি টেনিসন যখন বলেন,

'Ring out the old, Ring in the new.

Ring, happy bells, across the snow.

The year is going, let him go.

Ring out the false, ring in the true'

আর তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখতে পাই আরেক নান্দনিক উচ্চারণ;

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ

তাপসনিশ্বসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,

অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,

অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।

রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি,

আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ

মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক। ’

এভাবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে, গানে এই কল্যাণ প্রার্থনাই বারবার ঝংকৃত। বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘নববর্ষ উৎসব : রূপ-রূপান্তর’ প্রবন্ধে লিখেছেন—

‘বাঙালির নববর্ষ উৎসবে রূপ-রূপান্তরের যে ছোঁয়া লেগেছে, আমাদের সৃষ্টিশীল ভুবনের দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই উপলব্ধ হবে। মধ্যযুগের কবিদের রচনায় বৈশাখ এসেছে প্রধানত প্রকৃতির অনুষঙ্গে। উত্তরকালে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতা ও গানে নববর্ষ এসেছে জীর্ণ-পুরাতনকে সরিয়ে নতুনের আহ্‌বান উৎস হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ জীর্ণ-পুরাতন-গতানুগতিক জীবনকে বর্জন করে বৈশাখের আগমনে নতুন সত্ত্বা নিয়ে সকলকে জাগ্রত হবার আহ্বান জানান।’

সনাতন-গতানুগতিক প্রচল সমাজের পরিবর্তে নতুন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার ডাক থাকলেও রবীন্দ্রনাথের গান এখানে বিগত বছরকে ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে আহ্‌বানেই মুখর। কাজী নজরুল ইসলামের গানেও আমরা ওই একই ধারার অনুবর্তন লক্ষ করি। নজরুল লিখেছেন,

‘এলো এলোরে বৈশাখী ঝড়,

ঐ বৈশাখী ঝড় এলো এলো মহীয়ান সুন্দর।

পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর,

চরাচর থরথর

ঘন বনকুন্তলা বসুমতী

সভয়ে করে প্রণতি,

পায়ে গিরি-নির্ঝর 

ঝর ঝর।

ধূলি-গৈরিক নিশান দোলে

ঈশান-গগন-চুম্বী

ডম্বরু ঝল্লরী ঝনঝন বাজে

এলো ছন্দ বন্ধ-হারা

এলো মরু-সঞ্চয়

বিজয়ী বীরবর। ’

নজরুলের গানেও প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে পুরনোকে দূর করে নতুনের আবাহনী সুর উচ্চারিত। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালির সৃষ্টিশীলতায় বৈশাখ এভাবেই উপস্থিত হয়েছে। কবিরা-গীতিকাররা বৈশাখকে দেখেছেন নতুনের অনন্ত উৎস হিসেবে।

উত্তরকালে নববর্ষ বা বৈশাখবিষয়ক কবিতায় কখনো ভিন্ন মাত্রার প্রকাশ ঘটেছে। সে সময় কবিদের রচনায় বৈশাখ উপনিবেশ শাসিত বাংলাদেশে উপস্থিত হয়েছে মুক্তির উৎস হয়ে। সমাজ বদলের আহ্বানই উপনিবেশ পর্বের নববর্ষ-উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দেয়। মিলিত বাঙালির সংঘচেতনায় ঔপনিবেশিক পর্বের নববর্ষ অভিষিক্ত হয় বিপ্লবের বীজমন্ত্র হয়ে, কবির কণ্ঠে তাই ঘোষিত হলো এই বাণী।

বৈশাখ যুগে যুগে বাঙালির কাছে হাজির হয়েছে নতুন নতুন রূপে, বাঙালি বৈশাখকে নানা সময় নানভাবে গ্রহণ করেছে। নববর্ষে জাতিকে আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্‌বান করে যখন রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দেন;

‘নববর্ষে করিলাম পণ

সব স্বদেশের দীক্ষা। ’

কবি শশাঙ্ক মোহন সেন একটি বর্ষ শেষে নতুন বর্ষের আবির্ভাব সম্পর্কে লিখেছেন—

‘একটি বৎসর পরে

আজি পুনঃ নীলাম্বরে

হাসি হাসি সুধামুখ যায় গড়াইয়া

এ হাসির স্রোতে ভাসি

হাসির কণিকা রাশি

তারকা বালিকাগুলি গিয়াছে মজিয়া। ’

এভাবে দেখা যায়, বৈশাখ বা নববর্ষ বাঙালি কবি-শিল্পীদের কাছে যুগে যুগে যুগান্তরে নতুন নতুন ভাবের উৎস হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বাঙালির আত্মবিকাশের সঙ্গে, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের উৎস ধারায় বৈশাখ বা নববর্ষ সব সময় জড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।

কবি নজরুলের কণ্ঠ শোনা যায় এখানেও—

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর। ’

বাংলা নববর্ষের এবারের উদযাপন নানা কারনেই ব্যতিক্রম হেতু অনেকটা বেদনা-বিধুরও বটে। কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক সংকট হিসেবে মানব জীবন যেখানে বিপর্যস্ত এবং মানবতা যেখানে চরমভাবে লংঘিত, বাঙ্গালী জাতির নববর্ষ বরণ সেখানে কতটা আনন্দের তা বলাই বাহুল্য। তথাপিও আমাদের দেশের সকল শিক্ষক সমাজ, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক সম্প্রদায় ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে অতি ঘরোয়াভাবে নববর্ষ উদযাপন করতে পারেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন, যেমন-

শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র ছাত্রী মিলে ভার্চুয়ালি নববর্ষের এ দিনটি উদযাপন করতে পারেন; বাংগালী সাজে সাধ্যমত বাহারি পোশাকে সীমিত পরিসরে  চিত্ত বিনোদন করতে পারে; শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতে পারেন; নববর্ষ উদযাপনের নামে শিক্ষার্থীরা যেন কোন ধরনের অশালীন ও অপসংস্কৃতি চর্চায় লিপ্ত না হয় সেদিকে শিক্ষকগন সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারেন; নববর্ষকে কোন ধর্মীয় আবেশে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং বাংঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষা গ্রহন করা যেতে পারে; নববর্ষের উদযাপন যেন সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার উর্দ্ধে থেকে যার যার ধর্মের অনুশাসনের মাধ্যমে পালিত হতে পারে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করতে হবে; সর্বোপরি,  এবারের নববর্ষ যেহেতু কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাক্কালে আবির্ভূত,  সেহেতু বাহিরে যে কোন জনসমাগম এড়িয়ে সম্পুর্ণ ঘরোয়া আয়োজনে দিনটি উদযাপন করে দিনটির ঐতিহ্য ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

মোট কথা, নববর্ষ ১৪২৮ আমাদের মাঝে যে পরিবেশেই আবির্ভূত হোকনা কেন, এ দিনটি যে আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, কালচার ও সভ্যতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা আমাদের সকলকেই উপলব্ধি করতে হবে এবং ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগনের মাঝে এ দিনের মহান বার্তা এভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যে, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের জাতিস্বত্তার প্রতিক,  বাংলা বর্ষপঞ্জি আমাদের মহিমান্বিত সন গণনার মাধ্যম এবং বাংলা নববর্ষ আমাদের প্রাণের স্পন্দন। এদিনের ঐতিহ্য ও শিক্ষা আমাদের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরো জাগ্রত করে আমাদের হৃদয়ের গভীরে তা সর্বদা অনুরণিত হোক এটিই বাঙ্গালী জাতির প্রত্যাশা।

লেখক: প্রবন্ধিক, শিক্ষা গবেষক ও প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল


সর্বশেষ সংবাদ