উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশনজট, চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ চাই
বর্তমানে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয় সরকারি চাকরিকে। কিন্তু স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরি চলে আসে প্রথম অগ্রাধিকারে; এরপরই স্থান পায় বেসরকারি কর্পোরেট বডির চাকরি এবং সরকারি চাকরির স্থান হয় তিন নম্বরে। কিন্তু বর্তমানে ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মতো প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে সরকারি চাকরি। এর মধ্যে বিসিএস অন্যতম।
অথচ এ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের ব্যাপারে শুধু বয়সের মারপ্যাঁচে বেকারত্বের লম্বা সারি তৈরী হচ্ছে। বয়স ৩০ পার হওয়া মানে অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! সহজ কথায়, কত শত কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করা সার্টিফিকেটের আর কোনো মূল্যই নেই! তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার।
করোনাকালে বেকারের সংখ্যা আরও বেড়েছে। কোনো চাকরির আবেদনও করতে পারছে না তারা। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর বিস্তার বাড়তে থাকায় গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির মধ্যে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। তার আগে গত ডিসেম্বর থেকে চাকরিতে নিয়োগের নতুন কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি কমিশন।
তবে ৩০ মে সাধারণ ছুটি শেষে জুনের প্রথম সপ্তাহে নন-ক্যাডারে বেশ কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বয়সের সর্বোচ্চ সীমা ৩০ বছর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে গত ১ জুন পর্যন্ত।
গত মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পিএসসি ছাড়াও অন্যান্য সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনও বন্ধ হয়ে যায়। গত মে মাসে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির এক জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মার্চ-এপ্রিল মাসে আগের বছরের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনেক কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের জব পোর্টালগুলো ঘেটে দেখা গেছে, গত বছরের এপ্রিল মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিমাণ আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কমেছে। তার আগে মার্চ মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম। দৃশ্যমান পরীক্ষার ভিতরে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে চলতি বছরের ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বসছে পেরেছে চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাছাড়া ঘরবন্দী সময় কাটছে বেকার এসব শিক্ষার্থীদের।
করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে চাকরির বিজ্ঞাপন বন্ধ থাকায় শুধু ৩০ বছরের প্রান্তে যারা ছিলেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সবাইকে। এবং সেশনজটের কবলে পড়ে অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের নির্ধারিত বয়সসীমা হ্রাস পাচ্ছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, করোনাকালে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার।
১৯৯১ সালে ১৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করে। সেই সেকেলে পদ্ধতিতেই চলছে চাকরির বয়সসীমা। নেই কোন সংস্কার। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সীসীমার দিকে তাকালে দেখতে পাই ভিন্ন চিত্র।
যেমন উত্তর আমেরিকায় ৫৯ বছর বয়সেও একজন নাগরিক সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এই বয়সসীমা ৩৫ বছর। ইতালি, কাতার ও তাইওয়ানেও এই একই বয়সসীমার মানুষ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর।
এবার আসি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো কেন প্রয়োজন সেই আলোচনায়। নানা কারনেই বয়সসীমা বাড়ানো অতীব জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে। করোনার ধাক্কা তা আরো গুরুত্ববহ করে তুলেছে। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় কয়েকটি কারন তুলে ধরছি-
১. চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়লে সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে।
২. উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে।
৩. শিক্ষিত বেকারের হার কমবে।
৪. রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে।
৫. মেধা পাচার বন্ধ হবে।
৬. অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে।
৭. রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশি সময় পাবে।
৮. তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে।
৯. গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে।
১০. বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে।
১১. শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং
১২. সর্বোপরি তরুণ জনগোষ্ঠী ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে।
তাছাড়া, চাকরিতে অবসরের বয়স নিয়ে চলছে সমালোচনা। বর্তমানে চাকরিতে অবসরের বয়স নির্ধারণ করা আছে ৫৯ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। এ কারণে অকালে অবসরে যাওয়া এ মানুষ সুস্থতার বিচারে আরও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকছেন; কিন্তু কর্ম পাচ্ছেন না (ফলে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রচুর আশঙ্কা রয়েছে)।
একইঙ্গে সুস্থসবল দক্ষ ও অভিজ্ঞ এ মানুষের সেবা না নেয়া জাতীয় অপচয়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে অবসরের বয়স (যেমন- ভারতে ৬০ বছর, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনে ৬৫ বছর এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানে ৬৬ বছর) বাংলাদেশের এ বয়স থেকে ঢের বেশি।
আশা করি, সদাশয় সরকার সব দিক বিবেচনায় নিয়ে অতিসত্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স অন্তত ৩৫ বছরে উন্নীত করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা ও অবিচারের ধারণা দূর করবে। একই সঙ্গে অবসরের বয়স ৬০ বছরে উন্নীত করা হবে। করোনাকালে নিয়োগ প্রায় বন্ধ থাকা এবং দীর্ঘ সেশনজট কাটানোর স্বার্থে এ মুহূর্তে বিষয়গুলো দ্রুত কার্যকর করা জরুরি কর্তব্য বলে মনে করি।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়