বাংলাদেশে ইসলামিক দলগুলোর ধারা ও সামসময়িক প্রেক্ষাপট

বিভিন্ন ইসলামিক দলের লোগো ও লেখক
বিভিন্ন ইসলামিক দলের লোগো ও লেখক  © টিডিসি ফটো

এক.

বাংলাদেশের ইসলামিক প্রায় সকল সংগঠন আদর্শ, বিশ্বাস, ধর্মপালনের রীতিনীতি ও মতবাদগত পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন ধারা-ফিরকায়, গ্রুপ-উপগ্রুপ এবং বিভিন্ন কোন্দলে বিভক্ত। বাংলাদেশে মৌলিকভাবে প্রধানত পাঁচ ধারায় ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে। (১) দেওবন্দী ধারা; (২) ব্রেলভী ধারা; (৩) আহলে হাদীস ধারা; (৪) জামায়াতে ইসলামী মওদূদীবাদ ধারা; (৫) উগ্র বা ভুয়া মুজাহিদ বা জঙ্গী ধারা।

ঠিক একইভাবে এগুলোর প্রভাবে বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলও বিভিন্ন ধারা-উপধারায় বিভক্ত। ওয়াজ-মাহফিলের প্রেক্ষাপট অনুযায়ীও পাঁচটি ধারা আছে। রীতিনীতি পালনের ক্ষেত্রে ধারাগুলোর অনেক পার্থক্য থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কৌশলের কারণে তা স্পষ্ট হয় না। এই ধারাগুলোর মধ্যে ১ম ধারাটি হলো কওমি, যা উলামায়ে দেওবন্দের  ধারা। এটি সবচেয়ে বড় ধারা। ২য় ধারা আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেমদের। ৩য় ধারা আহলে হাদিস বা সালাফি বা লা মাজহাবী মতবাদের অনুসারীদের। ৪র্থ ধারা জামায়াতী মওদুদীবাদ অনুসারীদের। ৫ম ধারা মাজার ওরসকেন্দ্রিক।

এছাড়াও আমাদের দেশে ইলমে তাসাউফের চার তরিকার অনুসারীও আছেন। পীর সাহেবরা তাদের অনুসরণ করেন। ওয়াজ-মাহফিলেও এর প্রভাব আছে। এই চার তরিকা হচ্ছে হযরত আবদুল কাদের জিলানীর ‘কাদেরিয়া’, হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর ‘চিশতিয়া’, মুজাদ্দেদে আলফে সানীর ‘মুজাদ্দেদিয়া’ ও হযরত বাহাউদ্দিন নকশেবন্দির ‘নকশবন্দিয়া’ তরিকা। ধর্ম পালনে বিভাজনের ক্ষেত্রে শিয়া-সুন্নী’র সাথে হানাফি-শাফেয়ী-মালেকি-হাম্বলি মাজহাবসহ খারেজী-রাফেজী-কাদিয়ানি তো আছেই!

দুই.

এবার দেখা যাক কোন ফেরকা বা ধারায় কত মূল দল আছে।

ক. দেওবন্দী ফিরকা

(১) তাবলীগ জামায়াত (মাওলানা সাদ,যদিও এখন দেওবন্দী বিরোধী সংস্কারপন্থি)

(২) তাবলীগ জামায়াত (মওলানা জুবায়ের)

(৩) ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই)

(৪) হেফাজতে ইসলাম

(৫) জমিয়তে ইসলাম (ওয়াক্কাস)

(৬) জমিয়তে ইসলাম (নূর হোসেন)

(৭) খেলাফত আন্দোলন

(৮) খেলাফত মজলিস

(৯) ইসলামী ঐক্যজোট (আজিজুল হক)

(১০) ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী)

(১১) ইসলামী ঐক্যজোট (মেসবাহুর রহমান)

(১২) ইসলামী ঐক্যজোট (ইজহারুল ইসলাম)

(১৩) নিজামে ইসলাম

দেওবন্দী ফিরকা’র বিভিন্ন দল, উপদল ও মতে বিভক্ত (দেওবন্দ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ৬জন আকবিরে সিত্তাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ফিরকা)।

খ. ব্রেলভী/রেজভি ফিরকা

(১) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত (চট্টগ্রাম)

(২) ফুলতলী (সিলেট)

(৩) দেওয়ান বাগী

(৪) রাজার বাগী

(৫) ফুলেশ্বরী

(৬) সুরেশ্বরী

(৭) এনায়াতপুরী

(৮) আটরশী

(৯) চন্দ্রপুরী

(১০) মাইজভান্ডারী

(১১) ইসলামীক ফ্রন্ট (মতিন)

(১২) ইসলামী ফ্রন্ট (জুবাইর)

(১৩) দাওয়াতুল ইসলাম

(১৪) মুনিরীয়া তাবলিগ কমিটি

(১৫) তরিকত ফেডারেশন

(১৬) গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ।

(১৭)আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট

ব্রেলভী ফিরকা ও সুফিবাদ বিভিন্ন দল-উপদল ও মতে বিভক্ত। পান থেকে চুন খসলেই নিজেরা একে অপরকে এবং ভিন্ন মতের দল-উপদলকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে থাকেন।

গ. আহলে হাদীসের ফিরকা

আহলে হাদীসের অনুসারীরাও বিভিন্ন দল-উপদল ও মতে বিভক্ত। যেমন-

(১) জমিয়তে আহলে হাদীস (ড. বারি)

(২) আহলে হাদীস আন্দোলন ও আহলে হাদীস যুবসংঘ (ড. গালিব)

(৩) আহলে হাদীস জামাআতে (ড. মুসলেহ উদ্দিন)

(৪)আহলে হাদীস আন্দোলন (আ: রাজ্জাক বিন ইউসুফ)

(৫) আহলে হাদীস তাবলীগে ইসলাম

(৬) জমিয়তে শুব্বানে আহলে হাদীস

(৭) আহলে হাদীস যুব সংঘ (মুযাফ্ফর)

(৮) মাদখালী আহালে হাদীস (আকরামুজ্জামান)

(৯) গোরাবা আহলে হাদীস।

আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরায়েশী ব্রিটিশ ভারতে ও পূর্বপাকিস্তানে জমিয়তে আহলেহাদীস নামে এই ফিরকা প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে নেতৃত্বের গোড়ামীর জন্য বিভিন্ন সময়ে দল ভেঙ্গে ভেঙ্গে ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিভক্তি হয়ে নতুন দল তৈরি হয়। তাকলীদ মানা না মানার কারণে কওমি ধারা’র সাথে আহলে হাদীসদের বিরোধ।

কাফী আল কুরায়েশি ও আবুল আলা মওদূদী’র আদর্শ ও মতবাদগত পার্থক্যের কারণে জামায়াতের ধারার সাথে বিরোধ।  অন্য সব ফিরকাকে বাতিল ফিরকা মনে করার কারণে সবার সাথে বিরোধ।

ঘ. জামায়াতে ইসলামী মওদূদীবাদ ফিরকা

(১) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী- ডা. শফিকুর

(২) আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি)- এএফএম সোলায়মান-মঞ্জু

(৩) জন আকাঙ্খার বাংলাদেশ- মঞ্জু (এটি পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদী’র মতাদর্শের ধারা)

ঙ. জঙ্গি ফিরকা

বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলো হলো

(১) শাহাদত-ই-আল হিকমা

সৈয়দ কাওসার হোসেনসহ মূল নেতৃত্বের সবাই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এই সংগঠনটিকে ইসলামিক ছাত্র শিবিরের বর্ধিত অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেশে জেএমবি, তৌহিদি জনতা, বিশ্ব ইসলামিক ফ্রন্টসহ আরও দুটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে ‘শাহাদাত আল হিক্কমা’র গভীর সম্পর্ক ছিল।

(২) হরকাতুল জিহাদ (হুজি)- দেওবন্দীপন্থি  মাদ্রাসার ছাত্রদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।

(৩) জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)

(৪) জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) (সালাফি বা আহলেহাদীসদের মতাদর্শের অনুসারী জঙ্গিনেতা আব্দুর রহমান ও সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে জেএমবি ও জেএমজেবি পরিচালিত হতো।)

(৫) হিজবুত তাহরির

(৬) আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)

(৭) আনসার আল ইসলাম

(৮) আল্লাহর দল (ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রাক্তন দুই নেতা মতিউল ইসলাম ও বাবুল আনসারের নেতৃত্বে পরিচালিত)

নিষিদ্ধের জন্য প্রস্তাবিত সংগঠনগুলো হলো- উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত, নব্য জেএমবি, দাওলাতুল ইসলাম বাংলাদেশ, হেযবুত তাওহিদ, আত-তামকীন, তামীরউদ্দীন বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফ্রন্ট, তৌহিদী ট্রাস্ট, শাহাদত-ই-নবুয়ত ও জামাত-আস-সাদাত।

রোহিঙ্গাভিত্তিক উগ্রপন্থী সংগঠন- ইসলামিক সলিডারিটি ফ্রন্ট, আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান পিপলস আর্মি, আরাকান মুজাহিদ পার্টি, মিয়ানমার লিবারেশন ফোর্স, রোহিঙ্গা লিবারেশন ফোর্স, রোহিঙ্গা ইনডিপেন্ডেন্স পার্টি, রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেয়া সংগঠনগুলো হলো- জামিউতুল ফালাহ, আল হারাত-আল-ইসলামিয়া, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট, তৌহিদী জনতা, জুমাদআতুল আল সাদাত, তামিরউদ্দীন দ্বীন বাংলাদেশ, আল খিদমত, হিজবুল মাহদি, হিজবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, দাওয়াতি কাফেলা, বাংলাদেশ এন্টি টেররিস্ট পার্টি, আল মারকাজুল আল ইসলামী, আল ইসলাম মার্টেনস ব্রিগেড, সত্যবাদ, মুসলিম মিল্লাত, শরিয়া কাউন্সিল বাংলাদেশ, তাজির বাংলাদেশ, হায়াতুর ইলাহা, ফোরকান মুভমেন্ট, জামিউতুল এহজিয়া এরতাজ, আনজুমানে তালামিজ ইসলামিয়া, কলেমার জামাত, সাহাবা পরিষদ, কাতেল বাহিনী, মুজাহিদিন-ই-তাজিম, এশার বাহিনী, আল ফাহাদ, হরকাতুল মুজাহিদিন ও জাদিদ আল কায়দা।

এছাড়াও ব্যক্তিকেন্দ্রিক আরো অনেক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ইসলামিক সংগঠন রয়েছে। আর এভাবেই অসচেতনভাবে হুজুগে আগামীর বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!

তিন.

এতো ফিরকা, এতো ধারা, এতো মতাদর্শ, এতো উগ্রপন্থী, এতো বিভক্তির মধ্যে একজন সচেতন মুসলমান হিসেবে আপনি কোন দলটিকে বা কোন ধারাকে সমর্থন করবেন? এভাবে ইসলাম কে বিভক্তি করে নানা ধারা তৈরি করে তারা কিভাবে ইসলাম কে শান্তির ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে? এতো ধারা, এতো উগ্রপন্থা আজ ইসলাম ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কত মুসলমান অজ্ঞতার কারণে ধর্মান্ধতার  অন্ধ বিশ্বাস থেকে তাদের জীবন/পরিবার ধ্বংস করছে!

আমি ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম সর্বোচ্চ শান্তির ধর্ম আর দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ তা মানি। আমি একজন মুসলমান হিসেবে কোরআনের নির্দেশ মানবো, কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে ২/৩ টি হাদীস গ্রন্থ পর্যালোচনা করবো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবো, রোজা রাখবো, বাবা মায়ের সেবা করবো, পরিবারের প্রতি সমাজের প্রতি অর্পিত দায়ীত্ব পালন করবো, মানুষের উপকারে আসবো, অন্যের হক নষ্ট করবো না, প্রতিবেশীর দায়ীত্ব পালন করবো, মিথ্যা পরিহার করবো, গীবত করবো না, সুদ খাবো না। উগ্রপন্থা কে সমর্থন করবো না। যাকাত দিবো, কোরবানি-হজ্ব সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করবো। রাষ্ট্রের শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখবো, রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবো। এগুলোই তো একজন ঈমানদার মুসলমানের প্রধান কাজ, তাই নয় কি?

যদি তাই হয়, তাহলে সম্মানিত বুজুর্গ আলেমেদ্বীন যারা আছেন, বিভিন্ন ফিরকার প্রধান যারা আছেন তাদের অনুরোধ করবো, বিভক্তির উগ্র ও বিশৃঙ্খল ইসলাম নয় শান্তির ইসলাম প্রতিষ্ঠায় কাজ করুন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও উগ্রপন্থা মুক্ত শান্তিপূর্ণ একটি ফিরকা বা ধারার প্রকৃত ইসলামিক দল গঠনে আগে কাজ করুন। সমাজ সংস্কার করে প্রকৃত শান্তির ইসলাম প্রতিষ্ঠা করুন। তারপর না হয় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখিয়েন।

প্রকৃত একধারার ইসলাম গঠন করলে রাষ্ট্রপ্রধান যে ধর্মেরই হোক ঠিকই ইসলাম ধর্মের দিকেই তিনি অধিক গুরুত্ব দিবেন। মুসলমানদের একটিই দল হওয়া উচিত, তা হলো ঈমানদার মুসলমানের দল। তবেই ইসলাম গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠিত ধর্ম হবে।

দেশের স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিবৃন্দদের অনুরোধ করবো নিজ নিজ এলাকায় নিজেরা আগে জেনে-বুঝে ফিরকা বা ধারা বিভেদমুক্ত হয়ে সচেতন হোন, শান্তিপূর্ণ এক ধারার ইসলাম করার জন্য ইসলামিক দলগুলো উদ্বুদ্ধ করুন, সহযোগীতা করুন, প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগ করুন।

কারণ বিভ্রান্তি ও ধর্মান্ধতায় যারা নষ্ট হচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে, উগ্রপন্থী হচ্ছে তারা তো এই মাটিরই সন্তান! তাদের সচেতন করার সামাজিক দায়িত্বটাও কিন্তু আমাদের সকলেরই। সচেতনভাবে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে তবেই এ দেশ থেকে উগ্রপন্থা চিরতরে বিদায় হবে। শান্তির স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ হবে।

সরকার, ধর্ম মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাথে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা সমন্বয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দদের নিয়ে কাজ করলে আশা করি ভালো ফল পাওয়া যাবে। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ হোক।

লেখক: সহ-সভাপতি, ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।


সর্বশেষ সংবাদ