কল রেকর্ড ফাঁস: বাংলাদেশের আইন কী বলছে?

তামান্না আক্তার
তামান্না আক্তার   © সংগৃহীত

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় টেলিফোনে আড়িপাতায় ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পও অভিযোগ তুলেছিলেন, নির্বাচনের সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর ফোনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। গোটা বিশ্বের সব দেশেই ফোনে আড়িপাতা বড় ধরনের অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু আড়িপাতা বা কল রেকর্ড ফাঁস নিয়ে বাংলাদেশের আইন কী বলছে?

বাংলাদেশে রাজনীতির সংস্কৃতিতে ফোনকল রেকর্ড ফাঁস নতুন কোনো বিষয় নয়। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফোন কল রেকর্ড কিছুদিন পরপরই ফাঁস হচ্ছে। সম্প্রতি এই প্রসঙ্গটি আাবরো তুমুল আলোচনায় হেজাফত ইসলামের আমীর আল্লামা মামুনুল হকের একটি ফোন কল রেকর্ডকে কেন্দ্র করে।

মামুনুল হকের কলরেকর্ডগুলো সত্য নাকি মিথ্যা সে বিষয়ে বিতর্ক না করে রাষ্ট্রীয় আইনে বিবেচনা করলে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি সামনে চলে আসে। একজন ব্যক্তির ফোন কল তার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। সেই ব্যক্তিগত স্পেসে আক্রমণ বা রেকর্ড ফাঁস বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কী আছে সেটা কি বাংলাদেশের নাগরিক জানে?

বাংলাদেশের আইনেও কারো ফোনে আড়িপাতা, কল রেকর্ড ফাঁস করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের 'চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ, ফোনে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের গোপনীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখার নিশ্চয়তা দেয় আইন।

প্রচলিত আইন ও সাজা
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইন-২০০১ এ টেলিফোনে আড়িপাতার দণ্ড সংক্রান্ত ৭১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অপর দুজন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়িপাতেন তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির এই কাজ হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

২০০৬ সালে এ ধারায় সংশোধনী এনে এর সঙ্গে অপর একটি প্যারা জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭(ক)-এর অধীন সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্ত সংস্থার মতো সরকারি সংস্থাগুলোকে এই আইনের বাইরে রাখা হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে আবার সেই আইনটি সংশোধন করা হয়।

এ আইনে ফোনে আড়িপাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। তবে, কোনো ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ অপরাধে কারো শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আড়িপাতা কি বৈধ?
রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনে কোনো তথ্য নিতে আইনগতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো বাধা নেই। জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে, বিদেশী গুপ্তচর সন্দেহ করলে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এনটিএমসি'র (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেল) সহায়তায় কারো ফোন কল রেকর্ড করতে চাওয়ার আবেদন করতে পারে।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের জন্য ফোনের কথোপকথন বা বার্তা আদান-প্রদানের তথ্য রেকর্ড করতে হলে সরকার গোয়েন্দা সংস্থা, নিরাপত্তা সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে। তবে শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে এই বিধান প্রয়োগ করা যাবে।

তবে, নির্দিষ্ট কোন নাগরিকের কর্মকাণ্ড যদি রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বা হুমকি না হয়, তাহলে আদালতের নির্দেশনা ছাড়া কারো ফোনে কেউ বৈধভাবে আড়ি পাততে পারবে না। এটি ব্যক্তির নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ।

গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই রেকর্ড প্রচার কি আইনসিদ্ধ?
কোনোভাবেই অন্য কেউ তা কোনো মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি বারবার ফোনালাপ টিভি চ্যানেলসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হরহামেশাই প্রচার করতে থাকে। এটিও আইনত অপরাধ।

ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ফোন আলাপ রেকর্ড করা এবং রেকর্ড ছড়িয়ে দেয়া, আইনত অপরাধ। অনুমতি ছাড়া কারো ফোন আলাপের রেকর্ড ছড়িয়ে দিলে উক্ত ব্যক্তি প্রচলিত আইন অনুযায়ী মানহানির মামলা করতে পারেন। ডিজিটাল মাধ্যমে রেকর্ড ছড়ানো হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করতে পারেন। সংবিধান একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিলেও আমরা দেখেছি বারবার সেটি উপেক্ষিতই থেকেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ