২২ মার্চ ২০২১, ১৮:০১

লিবিয়ার রাজনীতিতে সুবাতাস: মুক্তির সম্ভাবনা কতটুকু?

  © টিডিসি ফটো

কথিত আরব বসন্তের এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতির নাম হচ্ছে লিবিয়া। ২০১১ সালে লিবিয়ার প্রয়াত শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির নির্মম শাহাদাতের পর দেশটি হয়ে যায় বহুধা বিভক্ত এক রক্তাক্ত জনপদ। এক নেতার পরিবর্তে আবির্ভাব হয় হয় হাজারো নেতার। অন্তঃলড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে তারা পুরো এক দশক। সাথে যোগ হয় বিশ্ব রাজনীতির কুশীলবদের নানান খেলা। মুয়াম্মার গাদ্দাফির সাজানো বাগান লিবিয়া হয়ে যায় উত্তপ্ত গোলাবারুদের প্রয়োগ খানা। শরণার্থীতে পরিণত হয় দেশটির লক্ষ-লক্ষ মানুষ। জীবন শঙ্কায় পড়ে যায় অধিকাংশ অধিবাসী। এমনই এক ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় সম্প্রতি লিবিয়ার রাজনীতিতে এক সুবাতাসের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গঠিত ‘লিবিয়ান পলিটিক্যাল ডায়ালগ ফোরাম’ মুক্তির একটি পথ বাতলে দিয়েছে। গঠিত হয়েছে মোহামেদ আল-মেনফি ও আব্দেল হামিদ দাবেইবাহর নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আপাতদৃষ্টিতে এই উদ্যোগ গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে একটি শান্তিুপূর্ণ সমাধানের পথ বলে আশা করা হচ্ছে।

তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে লিবিয়াকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক শিখরে নিয়ে গেছিলেন এক সময়ের জনপ্রিয় শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। কিন্তু বিরোধীদের উপর রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন, একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গোষ্ঠী অচিরেই পরিণত হয় তার শত্রুতে। কথিত আরব বসন্তের সময় এসব শত্রুরা - ইসলামপন্থী, সংস্কারপন্থী, উদারনৈতিক ও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সবাই মিলে ডাক দেয় গাদ্দাফি পতনের আন্দোলন। বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র। আট মাসব্যপী যুদ্ধ শেষে সির্তে শহরে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে নির্মমভাবে শহীদ হন মুয়াম্মার গাদ্দাফি।

তাঁর মৃত্যুর পর কার্যত লিবিয়া পরিণত হয় রণক্ষেত্রের নতুন চারণভূমিতে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিজেরাই জড়িয়ে পড়ে সংঘাত-কলহ-যুদ্ধে। ২০১২ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে মতরনৈক্য আর কামড়াকামড়িতে বিপর্যয় আরও ঘণীভূত হয়। ২০১৫ সাল থেকে বহুমুখী সমীকরণের পর গৃহযুদ্ধ অবশেষে দুটো প্রধান শিবিরে মধ্যে চলমান থাকে। এই দুটি শিবিরের একটি হলো, ত্রিপোলি ভিত্তিক জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ সরকার। অপরটি হলো, তবরুকভিত্তিক তথাকথিত জেনারেল হাফতার নিয়ন্ত্রিত এলএনএ সরকার। এই দুই শিবিরের যুদ্ধ কিছুটা কমে আসে গত বছরে খলিফা হাফতারের ত্রিপোলি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর।

এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গঠিত ‘লিবিয়ান পলিটিক্যাল ডায়ালগ ফোরাম’ একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়ে বহুধা বিভক্ত লিবিয়াকে একত্রীকরণের পদক্ষেপ নেয়। সেই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ দফা ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতনিধি। এই প্রচেষ্টায় ‘আন্ডারডগ’ পজিশন থেকে "মেনফি ও দাবেইবা" গ্রুপ শক্তিশালি "আগিলা-বাশাগা" গ্রুপের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে। শর্তানুযায়ী বিজয়ী গ্রুপ থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল প্রধান পদে নির্বাচিত হন পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী মোহাম্মদ ইউনুস আল-মেনফি। যিনি ২০১২ সালের নির্বাচনে তবরুক সিটি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এই গ্রুপ থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিলের মেম্বার পদে পশ্চিমাঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন জাওয়াইয়া সিটির পার্লামেন্ট মেম্বার আব্দুল্লাহ আল-লাফি আর দক্ষিণাঞ্চলের মুসা আল-কোনী।

বিজয়ী গ্রুপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন আব্দুল হামিদ দাবেইবাহ। যিনি পশ্চিমাঞ্চলের মিসরাতা সিটির অধিবাসী। গাদ্দাফির সময়েও যিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। অবশেষে গত ১৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে লিবিয়ার "জাতীয় ঐক্যের সরকার (জিএনইউ)" এর শপথ গ্রহণ সম্পন্ন হয়। পূর্বাঞ্চলীয় সিটি তবরুকে আয়োজিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে লিবিয়ার নতুন প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল, নতুন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ, পার্লামেন্টের স্পীকার সহ শতাধিক এমপি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। এর মাধ্যমে লিবিয়ায় একটি একক সরকার যাত্রা শুরু করলেও পূর্বাঞ্চলে হাফতার ও আগিলা সালেহ সমর্থিত বাহিনীসমূহ এখনো নিজস্ব কমান্ড অনুযায়ী কাজ করছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বেনগাজিসহ পূর্বাঞ্চলে "করোনা কারফিউ" জারির মাধ্যমে এখনো নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চাইছেন খলিফা হাফতার।

তবে এখন পূর্বাঞ্চলে হাফতারের পক্ষের চেয়ে বিরোধী পক্ষও কম নয়। হাফতারের পলিটিক্যাল ব্যাকার "তব্রুক পার্লামেন্টের" স্পীকার আগিলা সালেহ্ও বর্তমানে হাফতার বিরোধী গ্রুপগুলোর সাথে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।  ফলে পূর্বাঞ্চলে হাফতারের নেতৃত্বের "বিদায় ঘণ্টা" হয়তো বেশিদিন বজায় থাকবে না।

এমনই এক কঠিন সময়ে দায়িত্ব নিয়ে দাবেইবাহ এবং মেনফির ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে ওপর নির্ভর করছে আগামীর লিবিয়া কেমন হবে। অশান্ত লিবিয়াকে শান্তির পথে আনতে বহুধা বিভক্ত পুরো দেশের সমস্ত মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে নিষিদ্ধ করে সরকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সারাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা দাবেইবাহ সরকারের অন্যতম প্রধান টার্গেট হওয়া উচিত। এছাড়া উপজাতীয় ও গোষ্ঠীগত সংঘাত যেন ছড়িয়ে না পরে তাও নিশ্চিত করতে হবে। এই কঠিন কাজগুলো করতে পারলে হয়তো দাবেইবাহ-মেনফি কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে। লিবিয়ার সাধারণ মানুষের এক দশকের দুর্বিষহ জীবনযাপন থেকে মুক্তি দিতে পারে। এখন দেখা যাক দাবেইবাহ-মেনফি কতটুকু মুক্তি দিতে পারে?- সেই প্রত্যাশায়।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি