১৬ মার্চ ২০২১, ১২:১৭

ওরা বই পড়ছে, মাদক তো নিচ্ছে না

চাকরিপ্রত্যাশীদের খোলা স্থানে পড়াশোনা এবং অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর  © সংগৃহীত

আমি তখন জগন্নাথ হলের হাউজ টিউটর আবাসনে থাকি। সাত-সকালে গেট থেকে বেরুতেই দেখি আমার ছাত্র ধনঞ্জয় একহাতে কলা আর একহাতে পাউরুটি চিবোতে চিবোতে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। পেছনে ঝুলানো একটি ছোট্ট ব্যাগ। আমাকে দেখে থামলো কিন্তু ত্রস্ততা কমলো না। জিজ্ঞেস করে জানলাম, লাইব্রেরিতে যাচ্ছে, পড়তে, চাকরির পড়া, দেরি হলে আসন পাবে না। তাই সকালের খাবার বসে খাওয়ার সময় ছিল না ওর।

সেই ধনঞ্জয় এখন একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক। ও চাকরি পাওয়ায় বেঁচে গেছে পুরো পরিবার, ওর নিজের জীবনও হয়েছে বেশ গোছানো। অনেকদিন পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রশিক্ষণ কোর্সে ওর সঙ্গে আবার দেখা। সে এখন পান খায়। ঠোঁটে রঙিন হাসি নিয়ে বলে: ‘খুলনায় পোস্টিং। খুব ভালো আছি স্যার।’ আমার মন আনন্দে ভরে যায়। আমি এমন অনেক ধনঞ্জয়ের কথা জানি!

প্রবরদের আলোচনা চলছে এবং পত্রিকান্তরে সংবাদ বের হয়েছে, লাইব্রেরির বইয়ে ধুলো জমছে আর ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরির পড়া পড়ছে। বলি, বইয়ে ধুলোই ভালো নাকি ওরা লেখাপড়া করে চাকরি খুঁজছে সেটা? মনে হচ্ছে, চাকরিপ্রার্থীরা পকেটে ধুলো নিয়ে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে আর ছিটিয়ে দেয়! আসলে, তরুণ সমাজের লেখাপড়ার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দুটোরই সুতো এক জায়গায়। গবির মানুষের মেধাবী ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে চাকরি পাক, প্রতিষ্ঠিত হোক, পরিবারকে দিক, সমাজকে দিক, দেশকে দিক-অনেকেই চান না। এই ছাত্র-ছাত্রীদের উৎকোচ দেবার মতো অর্থ নেই, প্রভাবশালী মামা-চাচা নেই, এমন কি হলে বসে ঠিকঠাক পড়বে সেই স্থানটুকুও নেই নিজের। কারো আবার সৎ থাকার প্রাণান্ত ইচ্ছে আছে, এক পয়সাও দেবে না উৎকোচ। তাই ওরা বাধ্য হয়ে লাইব্রেরির ভেতরে যায় একটু লেখাপড়ার সন্ধানে। সেখানেও প্রবেশ করতে ভোর পাঁচটা থেকে লাইন দিতে হয় ওদের, সেখানেও প্রতিযোগিতা।

তারপর, জায়গাটুকু পেলেই হলো না, লোকাল ট্রেনের থার্ডক্লাস বগির ভাঙা আসনের মতো চেয়ার বা বেঞ্চে ঠাসাঠাসি করে বসে পড়তে হয় ওদের। ওদের বাবার যদি অঢেল টাকা থাকতো কিংবা প্রভাবশালী মামা-চাচা থাকতো তাহলে এই ইঁদুরদৌড় না দিলেও হতো। কিন্তু ওরা বড় অসহায়। লেখাপড়া শেষে যদি চাকরি ওরা না পায়, তাহলে হয়তো কারো বোনের বিয়ে আটকে যাবে, বাবার অবসরজনিত কারণে কারো সংসারে হয়তো স্থবিরতা আসবে, কারো অসুস্থ মা হয়তো মৃত্যুশয্যায় পতিত হবেন আর নিজের স্বপ্নও পূরণ হবে না। তাই ওরা পত্রিকার তীর্যক লেখা, অধ্যাপকদের ভ্রূকুটি, কথিত মেধাবীদের শ্লেষ উপেক্ষা করে চাকরির বই নিয়ে লাইব্রেরিতে যায়। কিন্তু সেখানে ওরা পড়ে, অন্য কিছু করে না।

লাইব্রেরিতে গিয়ে তো ওরা-- ১. মাস্তানি করে না, ২. গালাগাল করে না, ৩. টেন্ডারবাজি করে না, ৪. পকেট মারে না, ৫. প্রত্যুষ থেকে রাত-অবধি ঘুমায় না, ৬. হোটেলের মতো আয়েশ করে খাদ্যগ্রহণ করে না, ৭. রাজনৈতিক লবিং করে না, ৮. মাদক নেয় না। তাহলে ক্ষতি কী? ওদের জন্য কি কোনো কথিত মেধাবী ছাত্র আসন বা বই পায়নি? না। তেমন নয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদেই উল্লেখ আছে, বইয়ে ধুলো জমে। তাহলে বইয়ে ধুলো জমলো কেন? কারণ, সমালোচক কথিত মেধাবী ওই ছাত্র-শিক্ষকেরা নিজেরাই লাইব্রেরিতে যান না!

কয়েক বছর আগে দৈনিক প্রথম আলো ঢাকার গ্রন্থাগারগুলো নিয়ে প্রতিবেদন ছেপে জানিয়েছিল, এই ঢাকা শহরেই কতগুলো মহল্লা-লাইব্ররি ছিল সেই ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে। এগুলোর অনেকটাই উঠে গেছে, অনেকটা মিটিমিটি করে জ্বলছে। সারা দেশের অবস্থাই এটা। চাকরিপ্রার্থীরা গিয়ে যদি লাইন না দিতো তা হলে এই লাইব্রেরিগুলোরও প্রায় একই অবস্থা হতো। ওরা বই পড়ছে, এটিতে গাত্রদাহতো হবার কথা নয়।

উন্নত বিশ্বের লাইব্রেরিগুলোতে নিজের বই নিয়ে প্রবেশের অনুমতি আছে। কে কোন বই পড়বে, সেটি পাঠক নিজেই ঠিক করে। আমাদের মতো ‘সুশিক্ষিত’ দেশে যেখানে লাইব্রেরিতে ‘পাতাকাটা’, ‘বইচুরি’ ইত্যাদি হামেশাই হয়ে থাকে সেখানে লাইব্রেরিতে নিজের বই নিয়ে ঢুকতে দেয়া হয় না। দেয়া হয় না কারণ, নিজেরটির সঙ্গে যদি পাঠক লাইব্রেরিরটিও ‘মেরে’ দেন, এই ভয়। আমাদের শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রীরা যদি বইয়ের পাতা না কেটে লাইব্রেরিতে চাকরির বই পড়ে তাহলে দোষ কী? আমি বলবো, লাইব্রেরির সংখ্যা, এর আসন সংখ্যা বাড়াতে এবং যে কোনো ধরনের বই পড়ার পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে। স্বাধীনতার পর দেশে জনসংখ্যা ও শিক্ষার হার বাড়লেও লাইব্রেরিতো উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি।

এবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করা যাক এবং সেটি হলো: ওরা নাকি ‘গাইড’ বই পড়ে। আমার প্রশ্ন: চাকরির প্রশ্ন কারা করেন? আপনারা কেন এখনো চাকরির প্রশ্নের ধরন পাল্টাতে পারলেন না? দোষতো আপনাদের। আপনারা যেমন প্রশ্ন করবেন প্রস্তুতিও হবে তেমনি। শিক্ষা শেষে দরকার হলো সৎ পথে একটি ভালো চাকরি। গাইড বই পড়ে সহজে চাকরি পাওয়া গেলে কেন অন্য বই পড়বে ছাত্র-ছাত্রীরা? আপনারা নিজেদের জ্ঞান ও কর্মের সীমাবদ্ধতার দায় মেধাবী, গরিব ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপাতে চান? আপনারা নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নের ধরন পাল্টান, দেখবেন প্রস্তুতির ধরনও পাল্টেছে।

নিজেরা পদ-পদবি অধিকার করে থাকবেন, রাজনীতি করবেন, পদের লোভে সময় নষ্ট করবেন, পত্রিকায় কলাম লিখে ছবক দেবেন, টিভিতে টকমিষ্টি কথা বলবেন কিন্তু পরীক্ষার ধরন ও প্রশ্নকাঠামো পাল্টাবেন না (নাকি পাল্টানোর বিদ্যে ও দক্ষতা নেই)-তাহলে তো চাকরিপ্রার্থীদের এধরনের প্রস্তুতি থেকে ফেরানো যাবে না। অতএব, আগে আপনি ও আপনারা পাল্টান ‘মহাশয়’।

আমি ধনঞ্জয়ের মতো শত শত শিক্ষার্থীকে দেখেছি রুটি-কলা চিবোতে চিবোতে লাইব্রেরির দিকে দৌড়াতে। যারা লাইব্রেরিতে প্রবেশের জন্য ভোরে লাইন দেয়, তাদের মতো আপনি একদিন আসুন। দেখবেন, দিনটা খিটখিটে যাচ্ছে। আপনার সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটবে, কোষ্ঠ পরিষ্কার হবে না, নাস্তা করতে বুকটা জ্বালা-জ্বালা করবে, চোখে ঘুম-ঘুম ভাব থাকবে আর সারা দিন মাথাটা কেমন যেন করবে। এত্তোসব ওদেরও হয়।

এগুলো নিয়েই ওরা লাইব্রেরিতে একটু লেখাপড়ার জায়গার জন্য চোখ বুজে আপনার ‘ছবক’ সহ্য করে। ভাববেন না, ওরা মেধাবী নয়।মেধার স্বাক্ষর রেখেই কিন্তু ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা শেষে সম্মানজনক কাজের ন্যূনতম নিশ্চয়তা যখন নেই, তখন ওরা এই ইঁদুরদৌড়ে নেমেছে। ওদের অসম্মান করবেন না, প্লিজ!

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)