৪১তম বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মনে করোনার শঙ্কা
বর্তমানে পৃথিবীর সকল দেশের ন্যায় বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো করোনাভাইরাস মোকাবিলা। ভাইরাসটির ভয়াবহতা তথা এর মৃত্যু ঝু্ঁকির কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বিশ্বের সব দেশেই বিশেষ করে উন্নত দেশসমূহও একাধিকবার এর প্রকোপে লকডাউন ও জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
হতাশার বিষয় এই যে, এখন পর্যন্ত করোনায় বিশ্বে ২৬ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে এবং ১২ কোটিরও অধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের এর সংখ্যা কম নয়। এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্য সাড়ে ৮ হাজার এবং আক্রান্ত সাড়ে ৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে। আরো উদ্বেগের কারণ প্রতিদিনই মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যেখানে পরীক্ষা অনুপাতে আক্রান্তের হার ২% ছিল তা মার্চে এসে পরীক্ষা অনুপাতে আক্রান্তের হার ৭% ছাড়িয়েছে।
তাছাড়া এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার করোনার স্ট্রেনও বাংলাদেশে ধরা পড়েছে। এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ অব্স্থার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা বেশি। একটা বিষয় গভীরভাবে ভাবা দরকার যে গত ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হবার ঠিক এক বছর পর মার্চে এসেই আবারও করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার তথ্য মিলছে। সুতরাং আগের বছরের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে আগামী ২-৩ মাস আমাদের জন্য আরো হুকমি স্বরূপ।
এমতাবস্থায় সরকার দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ৩০ মার্চ থেকে খোলার ঘোষণা দিলেও তা আবার পরিবর্তনের আভাস মিলেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ একাধিক সরকারি কর্মকর্তা কথায়। তাছাড়া শিক্ষক, অভিভাবক ও বিভিন্ন সচেতন মহলও এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিপক্ষে। অন্যদিকে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসবের পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ২৪ মে পর্যন্ত।
কিন্তু এতো কিছুর সত্ত্বেও আগামী ১৯ মার্চ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানীয় চাকরির পরীক্ষা ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারির আসর বসতে যাচ্ছে দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে। যেখানে ১৭০টি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রায় পৌনে ৫ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। তাছাড়াও এতে পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরীক্ষায় নিয়োজিত পরীক্ষক এবং অভিভাবকসহ আরো ২-৩ লক্ষ মানুষের অর্থাৎ পরীক্ষার্থীসহ ৭-৮ লক্ষ মানুষের একটা সমাগম ঘটবে। যা হবে করোনা কালীন সময়ে দেশের সর্বোচ্চ জন-সমাবেশ। এতে করে করোনা সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
তাছাড়া ৮টি বিভাগের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে করোনা সংক্রমনের হার ভয়ানক। আবার পরীক্ষা যেহেতু বিভাগীয় শহরগুলোতে হবে তাই পরীক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে ৫০ কি.মি. থেকে ২০০ কি.মি. বা তার বেশি দূরুত্ব থেকে ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে কেন্দ্রে আসবেন। আবার একই দিনে এবং একই সময় পরীক্ষা হওয়ায় সীমিত সংখ্যক পরিবহনে করে পরীক্ষার্থী-অভিভাবকদের গাদাগাদি করে আসা যাওয়া করতে হবে।
অন্যদিকে বিসিএস পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর তথা চাকরি প্রার্থীর মনের মধ্যে পুষে রাখা একটা স্বপ্ন এবং সাধনা, তারা বহুবছর ধরে এরজন্য পরিশ্রম করে থাকেন। তাই যেকোনো মূল্যে তারা পরীক্ষায় অংশ নেবেন, যদি তারা করোনা পজিটিভও হোন তাহলেও তা গোপন করে হলেও তারা পরীক্ষাতে বসবেন। অথবা কোনো প্রার্থী যদি করোনা জনিত কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারেন বা তাকে শারীরিক তাপমাত্রা নির্ণয়ের পর সন্দেহ জনিত কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয় তাহলে এর দায়ভার কে নেবে?
করোনা বর্তমানে একটা সার্বজনীন সমস্যা, এটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু। এতে একজন পরীক্ষার্থীর ব্যক্তিগত কোন দোষ নেই। শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা তার মৌলিক অধিকার। সংকটময় পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ চাকরির পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ও সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব।
দেশের অন্যান্য চাকরি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ও চাকরি প্রার্থীরা পিএসসিকে (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) আইডল/আদর্শ মানেন। সেখানে পিএসসি কর্তৃপক্ষ যদি পরীক্ষার্থীদের একটা বৃহৎ অংশের দাবি ও পরিস্থিতি বিবেচনা না করে জিদের বশে তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে তা হবে জাতির জন্য হতাশার। অন্যদিকে, পিএসসি কর্তৃপক্ষের একটি নমনীয় পদক্ষেপ হতে পারে হাজার হাজার মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, তা হতে পারে দেশের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যেখানে শিক্ষামন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিষয়ে গত এক বছরে একাধিক বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে সেখানে পিএসসি কেন একবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবে না, তা বোধগম্য নয়। অথচ পরীক্ষা পেছানোতে কারো ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ পরীক্ষার্থী সংখ্যা নির্দিষ্ট এবং তাদের বয়সসীমা পার হবার কোনো ভয় নেই। বরং এতে পরীক্ষার্থীসহ সকলের একদিকে যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে অন্যদিকে করোনা জনিত বিভিন্ন কারণে যেমন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসুস্থতায় এবং আর্থিক ও অবস্থানগত সমস্যায় যারা ভাল প্রস্তুতি নিতে পারছিলেন না তারাও কিছুটা সুবিধা পাবেন।
সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসসহ সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ পরীক্ষার্থীদের মনে প্রবল করোনাভীতি সৃষ্টি করেছে এবং ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশে করোনা জনিত কারনে বিসিএস পরীক্ষা স্থগিতকরণ পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা তারিখ পরিবর্তনের দাবিকে আরো যৌক্তিক করে তুলেছে।
আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকেন। আর তাদের বেশির ভাগই অবস্থান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ মুহুর্তে নিজ নিজ জেলায় বা বাসায় অবস্থান করছেন। তাই সেখান থেকে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা তাদের জন্য এ মুহুর্তে বেশ কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে, এতদসত্ত্বেও আশার ব্যাপার হলো বর্তমানে বিভিন্ন দেশ করোনার টিকা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে এবং এর সার্থক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশে পর্যায়ক্রমে দ্রুত টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, আশাকরা যায় অনতিবিলম্বে দেশের করোনা ঝুঁকিতে থাকা সকলকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সুতরাং সার্বিক দিক বিবেচনায় এবং জনস্বার্থে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ রূপে খোলার, টিকার যোগ্য বা ঝুঁকিতে থাকা সকলের করোনা টিকা নিশ্চিত করার এবং সার্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগ পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষা স্থগিত রাখতে পিএসসি কর্তৃপক্ষ ও সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ এ মুহূর্তে একান্ত কাম্য।
লেখক: ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার্থী ও সাবেক শিক্ষার্থী, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া