বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

ড. মো. আকরাম হোসেন
ড. মো. আকরাম হোসেন  © টিডিসি ফটো

আজ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির শেষ দিন। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করা প্রভৃতি দাবি নিয়েই মূলত ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষার এই আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় পাকিস্তানি শাসকবর্গের অদূরদর্শী, নিবর্তনমূলক ও অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ ও আচরণের কারণে বাঙালিদের মন-মানস ক্রমশ তাদের প্রতি বিরক্ত থেকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে থাকে।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানা পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটি পরিচালিত হয়; সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখের শাহাদতের মধ্য দিয়ে যা পূর্ণতা লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান আজ ইতিহাস-স্বীকৃত। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে এই অবিসংবাদিত নেতা যেমন হাজার বছরের প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ এনে দিয়েছেন, তেমনি ভাষা আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে বাঙালিকে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রেখেছেন অনন্য অবদান।

আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলা ভাষা এক ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় স্থান দখল করে নিয়েছে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে একঝাঁক সম্ভাবনাময় তরুণের বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গীত হয়েছে; মায়ের ভাষার জন্য এমন গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয়টি বিরল।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার কথা তিনি নিজেই তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকেও উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু মুসলিম লীগ চেয়েছিল কেবল উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'আমরা দেখলাম,বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করলো এবং দাবি করলো, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এ সময় পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহবান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করলো (অসমাপ্ত আত্মজীবনী-৯১ পৃষ্ঠা)। এ বক্তব্য থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ত্রিশের কোটায় স্বপ্নবাজ এক যুবক শেখ মুজিবের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর সম্পৃক্ততার প্রমাণ বহন করে।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেই বঙ্গবন্ধু থেমে থাকলেন না। তিনি অন্যদের নিয়ে এ দাবিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়লেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সমাবেশ, মিছিল ও তাঁর স্বভাবজাত অসামান্য বাগ্মিতা দ্বারা বঙ্গবন্ধু জনমত তৈরীতেও ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম।”

দৌলতপুরের সমাবেশে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা গোলমাল করে। সেখানে মারপিটের ঘটনাও ঘটে এবং অনেকেই আহত হয়। তবুও বঙ্গবন্ধু সমাবেশ ভাঙ্গেননি। বক্তব্য চালিয়ে গেলেন একদম শেষ পর্যন্ত।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতাল পিকেটিংসহ সমগ্র আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নকারী নেতা শেখ মুজিব ১১ মার্চ রাজপথ থেকেই গ্রেফতার হন। তাঁর সাথে আরো ৭০-৭৫ জনকেও জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু যে আন্দোলন সারা বাংলায় দানা বেঁধেছে সে আন্দোলন কি নেতাকর্মীদের জেলে আটকে রেখেই থামিয়ে দেয়া সম্ভব? বরং নতুন উদ্যমে আন্দোলন চলতে থাকলো। অবশেষে আন্দোলনের চাপের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার রাজবন্দীদের ১৫ মার্চ মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে যে ১৪ জন নেতাকর্মী ২১ দফা দাবিসহ একটি পুস্তিকা প্রচার করেছিলেন শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পুলিশি নির্যাতন, হামলা-মামলা, লাঠিচার্জ ছিল ভাষা আন্দোলনের সময়কার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু যে আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর মত দৃঢ়চেতা ছাত্র ও যুবনেতারা নেতৃত্ব দেন সেই আন্দোলনকে তো আর লাঠিচার্জ করে দমিয়ে দেয়া যায় না। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ' রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'র সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। পরবর্তী মন্ত্রীত্বের লোভ অনেক প্রবীণ নেতাকেও আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। কিন্তু অসম সাহসী শেখ মুজিবকে কাবু করা সম্ভব হয়নি। তিনি তাঁর অন্যান্য সাথীদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেলেন।

১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন ছাত্ররা “না, না, না!” বলে চিৎকার করে উঠেন। ভাষার প্রশ্নে বাংলার দামাল ছাত্রদের মনোভাব সেদিনই যা বোঝার তা পুরোপুরি বুঝে নিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫১ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন আবারো ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। ১৯৫০ সালেই তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ও বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন। কিন্তু কারাবন্দী থাকা অবস্থায়ও তিনি তাঁর ভাষা আন্দোলনকারী সঙ্গীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।

কারাগার থেকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে এখানে এসেও তিনি ছাত্রলীগ ও ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী নেতাদেরও খবর দিয়েছিল। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাশ করে নিবে।.... খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে। কারণ, আমি নাকি হাসপাতালে বসেও রাজনীতি করছি (অসমাপ্ত আত্মজীবনী -১৯৬)।” ভাষা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা যেন তিনি না দিতে পারেন তাই তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর কারাগারে পাঠানো হয়।

তবু অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ করি যে, স্থানান্তরিত হওয়ার পথেও তিনি নারায়ণগঞ্জে নেতাকর্মীদের ভাষা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেন। ফরিদপুর কারাগার থেকেও তিনি চিরকুটের মাধ্যমে আন্দোলন চাঙ্গা রাখার পরামর্শ দিতেন।

২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত হলো। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জনগণ এগিয়ে আসবে। কেননা, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তাদের পায়ে আবার দাসত্বের শিকল পরানো হবে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “২১ ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম। রাতে সিপাহীরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর, ফরিদপুর হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেট পর্যন্ত এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক প্রতিবাদী স্লোগান।”

ভাষার মিছিলে গুলিতে শহীদ হওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করলো। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালীরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলনের জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই।”

১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় উপস্থিত জনতার সামনে এক আবেগঘন বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, “আজ মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি। শহীদ দিবসে আপনারা এখানে এসেছেন। ১২ টা ১ মিনিটের সময় আমি মাজারে গিয়েছি, সেখান থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। ১৯৫২ সালে যে রক্ত দেয়া শুরু হয়েছে তা আজও শেষ হয় নাই। কবে হবে তা জানি না। আজ শহীদ দিবসে শপথ নিতে হবে, যে পর্যন্ত সাত কোটি মানুষ তার অধিকার আদায় করতে না পারবে, সে পর্যন্ত বাংলার মা -বোনেরা, বাংলার ভাইয়েরা আর শহীদ হবে না, গাজী হবে।”

এই বক্তব্য স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একটা বিরাট বড় ইঙ্গিত ছিল। বঙ্গবন্ধু ভাষাসৈনিকদের অন্যতম নেতা হলেও আমরা ভাষাসৈনিক হিসেবে কেবল কয়েকজনের নাম জানি। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার ছাড়াও যে আরো ভাষা সৈনিক ও নেতাকর্মী ছিলেন তাঁদের সম্পর্কেও আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানতে হবে। ভাষার মাসের শেষ দিনে সকল ভাষা শহিদ ও সৈনিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি; যিনি বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ।

লেখক: কোষাধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি


সর্বশেষ সংবাদ