প্রযুক্তি কেড়ে নিচ্ছে শিশু-কিশোরদের দুরন্ত শৈশব
- আরিফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:২৬ AM , আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:২৬ AM
আধুনিকায়নের যুগে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল প্রজন্ম। ছেলেমেয়েদের শৈশবের দুরন্তপনা এখন প্রযুক্তির দেয়ালে বন্দি। যে বয়সে ছেলেমেয়েদের বাধাহীন জীবনযাপন, খেলার মাঠে ছুটে চলা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠার কথা সে বয়সেই ছেলেমেয়েরা ঘরবন্দী থেকে স্মার্টফোনসহ প্রযুক্তিগত বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ক্রমশ পরিবর্তনে রূপ নিয়েছে ছেলেমেয়েদের বর্তমান শৈশব।
বর্তমানে নিরাপত্তার স্বার্থে বেশিরভাগ অভিভাবকরা চান না তাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে বের হোক। যার প্রভাবে ছেলেমেয়েরা দিনের প্রায় পুরোটা সময় গৃহবন্দী অবস্থায় পার করছে। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই খেলাধুলা বিমুখ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়ন নতুবা অপদখলের শিকার বেশিরভাগ খেলার মাঠ। এছাড়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই নিজস্ব কোন খেলার মাঠ। পর্যাপ্ত মাঠের অভাবে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলেও এখন বিপন্নপ্রায় খেলার মাঠ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলা।
পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে কানামাছি, হাডুডু, নৌকাবাইচ, লুকোচুরি, গোল্লাছুট, লাঠিখেলা, এক্কা-দোক্কাসহ অনেক খেলার নাম জানা থাকলেও পর্যাপ্ত মাঠ না থাকা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবে খেলার সৌভাগ্য হচ্ছে না বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের। পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ না থাকায় গৃহবন্দী শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এছাড়া শহরাঞ্চলে বিনোদন কেন্দ্র ও পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একধরনের হতাশা৷ প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে ক্রমশ বিপথগামীতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
শিশুবান্ধব পরিবেশ, পর্যাপ্ত খেলার মাঠ সংরক্ষণ ও পরিচর্যায় দায়িত্বশীল সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে প্রযুক্তির কড়াল গ্রাসে অচিরেই বর্তমান প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের বিনোদনের একমাত্র সঙ্গী হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্র। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই এখন গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ে আসক্তির ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বাড়ছে নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের অনুভূতি। এছাড়া টেলিভিশনের 'কার্টুন', 'অ্যানিমেশন', 'ফেসবুক', 'কম্পিউটার', 'ল্যাপটপ, 'ইন্টারনেট', 'টুইটার'- এসবে বুঁদ হয়ে আছে বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটছে না।
এছাড়া প্রযুক্তির মায়াজালে থাকতে থাকতে শিশু-কিশোরদের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধছে। খেলাধুলা না করাতে শিশুরা বাড়ছে স্থূলকায় শরীর নিয়ে। এছাড়া চোখে সমস্যা, নিদ্রাহীন, মাথা ব্যাথা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ এখন শিশু-কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও পারিবারিক দৃঢ়তার অভাবে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির অপব্যবহারে মেতেছে৷
বর্তমানে অনেক বাবা-মা তাদের শিশু সন্তানকে শান্ত রাখতে স্মার্টফোনে বিভিন্ন ভিডিও বের করে দেখতে দেয়। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়, এভাবে সমাজে বেশিরভাগ পরিবারের শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তি উপভোগ করার অভ্যাস গড়ে উঠছে। এছাড়া পিতা-মাতার অগোচরেই বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির অপব্যবহারে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সাইবার অপরাধ ও ফেসবুকে সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর। এছাড়া প্রায়ই বর্তমানে উঠতি বয়সী শিশু-কিশোরদের আত্নহত্যার খবর শোনা যাচ্ছে। প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে সমাজে। বর্তমানে সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটছে যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘটনা।
শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার পেছনে পরিবারের সহযোগিতামূলক আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবারে সন্তানের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণের অভাব দেখা যায় যা সন্তানের জন্য সুফল বয়ে আনে না। পিতা-মাতার অতিরিক্ত শাসন এবং বয়সন্ধিকালে সঠিক পরিচর্যার অভাবে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে এক পর্যায়ে মাদকাসক্ত, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা এবং শৈশব থেকেই একজন শিশুর ভেতর মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বীজ বুনে দেওয়া।
সন্তানের শৈশবকে সুন্দর করতে অভিভাবকের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামীতার হাত থেকে রক্ষা করতে শিশু-কিশোরদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রোধ ও শিশুদের মানসিক গঠনে পরিবারের সদস্যদের সচেতন হতে হবে। শিশুর সুন্দর জীবন ও ভবিষ্যতের জন্য শিশুর শৈশবকে আরও আনন্দময় করে তুলতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী