রাবির ১৯৭৩ অ্যাক্ট সুরক্ষা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে হলুদ প্যানেলের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ

  © টিডিসি ফটো

আজ বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও মূলবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের (আওয়ামীপন্থী হলুদ প্যানেল) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবার দুটি প্যানেলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ৬ মে বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হবে। বর্তমান প্রশাসনের শেষ সময়ে এই নির্বাচনকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ অ্যাক্টের অধীন ১২নং ধারার উপাচার্যের ক্ষমতা ও কর্তব্য ২নং উপধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, 'উপাচার্যের কর্তব্য ১৯৭৩ অ্যাক্ট, স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্স যথাযথভাবে প্রতিপালন/মান্য করা। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান বেশ কিছু ক্ষেত্রে  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ অ্যাক্টের অধীন ১২নং ধারার (উপাচার্যের ক্ষমতা ও কর্তব্য) ২নং উপধারায় বর্ণিত কর্তব্য প্রতিপালন/মান্য করেন নাই।

রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্যতা যাচাইয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি উন্মুক্ত শুনানির ব্যবস্থা করে এবং উপাচার্যের অনিয়মের সত্যতা প্রমাণ পায়। ইউজিসির তদন্ত কমিটি সরকারকে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসির তদন্ত রিপোর্টের সত্যতা পেয়ে গত বছরের ১০ ও ১৩ ডিসেম্বর কিছু বিষয়ে নির্দেশনা দেয় ও কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর মূল উদ্দেশ্য 'ইমপ্রুভিং দ্য টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ' (তথ্যসূত্র :রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার; চ্যাপ্টার ১)। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উন্নত মানের শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে প্রায় আড়াই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে 'শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা' অনুমোদিত হয়, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ নামে পরিচিত।

কিন্তু ২০১৭ সালের ৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পর, একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ ব্যাপকভাবে শিথিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করেন।

২০১৭ সালে শিথিলকৃত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর মূল উদ্দেশ্য 'ইমপ্রুভিং দ্য টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ' থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিচ্যুত হয়ে রাবির শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পথ সুগম করা হয়েছে। সে কারণেই গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নীলিমা আফরোজ স্বাক্ষরিত পত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩-এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য নির্দেশক্রমে উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয়েছে। দূর্ভাগ্যবশত অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয় নাই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩-এর ২৯ ধারা 'দ্য ফার্স্ট স্ট্যাটিউটস অব দ্য ইউনিভার্সিটি'-এর ৩-এর ১ ধারায় বর্ণিত আছে, উপাচার্য জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে (অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদের নিচে নয়) পর্যায়ক্রমে তিন বছরের জন্য বিভাগের সভাপতি নিয়োগ দেবেন।

কিন্তু গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনা সংকটকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তিনটি বিভাগে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগের সভাপতি নিয়োগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করেন। এ বিষয়টি ইউজিসির উন্মুক্ত শুনানিতে এজেন্ডা ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য তার প্রথম মেয়াদে একইভাবে এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগে এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ২১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩-এর ২৯ ধারা 'দ্য ফার্স্ট স্ট্যাটিউটস অব দ্য ইউনিভার্সিটি'-এর ৩-এর ১ ধারা লঙ্ঘন করে সভাপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ অ্যাক্টের চ্যাপ্টার ৫-এর ধারা ২(সি)/অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পদ সৃষ্টি, উক্ত পদ পূরণার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি সংশ্নিষ্ট শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ। অর্থাৎ স্ব-স্ব বিভাগের প্লানিং কমিটি কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ ভিন্ন সিন্ডিকেটের শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ শুধু বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির ওপর ন্যস্ত। একমাত্র বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই সিন্ডিকেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান প্ল্যানিং কমিটির সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজেই তার প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়াদে কয়েকটি বিভাগের শিক্ষকের যোগ্যতা নির্ধারণ করেন এবং তা সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন দেন।

আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের ( আওয়ামীপন্থী হলুদ প্যানেল) স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বর্তমান রাবি প্রশাসন ও প্রশাসন বিরোধীদের দুটি প্যানেলে প্রশাসন পন্থীদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান এবং প্রশাসন বিরোধীদের পক্ষে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান উল ইসলাম টিপু আহ্বায়ক পদে নির্বাচন করবেন।

রাবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান রাবি প্রশাসন বিরোধী আন্দোলনে অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। তার এই অবস্থান পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক হতবাক হয়েছেন। বেশ কিছু শিক্ষক মনে করেন, রাবি প্রশাসন পন্থীদের পক্ষে আহ্বায়ক পদে প্রার্থী নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছেন। বর্তমান প্রেক্ষিতে রাবির ৭৩' অ্যাক্ট সুরক্ষা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে হলুদ প্যানেলের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ