গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় প্রহসনের সিলেকশন
একটি রাষ্ট্র গঠনে সে রাষ্ট্রের শিক্ষিত জনগণ সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন। বিশেষ করে যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত তারা রাষ্ট্র গঠনে অন্যদের থেকে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেন। আর বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু এ বছর চান্স পাওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসার নূন্যতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। ফলে এসব শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকেরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার ২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অটোপাস দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক এবং জেএসসির ফলাফল বিবেচনা করে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল মূল্যায়ন করা হয়।
এবার অটোপাসের ফলাফলে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। গতবছর এই সংখ্যা ছিলো ৪৭ হাজার ২৮৬ জন এবং ২০১৮ সালে ছিলো ২৯ হাজার ২৬২। অথ্যাৎ শুধুমাত্র এবছর উচ্চমাধ্যমিকে মোট যতজন জিপিএ-৫ পেয়েছেন তা বিগত কয়েক বছরের উচ্চমাধ্যমিকের সম্মিলিত জিপিএ-৫ প্রাপ্তের সংখ্যার সমান।
যাইহোক এতো সংখ্যক জিপিএ-৫ প্রাপ্তির জন্য বলা যায় সকলেই খুশি। কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। গত কয়েকদিনে প্রিন্ট এবং বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতা অনুযায়ী ভর্তিচ্ছু সকল শিক্ষার্থীর প্রাথমিক আবেদনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
তবে আবেদন করা প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করে নির্ধারিত সংখ্যক প্রার্থীদেরই শুধু ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে। গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় সবগুলা ইউনিট মিলিয়ে সর্বমোট ৪ লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিটে ১ লাখ ৩০ হাজারের কিছু বেশি প্রার্থী পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাবেন।
এমন সিদ্ধান্তে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন জিপিএ-৫ ধারির মধ্যে সিংহভাগই বিজ্ঞান বিভাগের। এবছর ১ লাখ ২৩ হাজার ৬২০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে।
এছাড় অনুমানের ভিত্তিতে বলা যায়, এসব জিপিএ-৫ ধারি বাদে আরও প্রায় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ শিক্ষার্থীর জিপিএ ৪.৭ এর উপরে। অথ্যাৎ যাদের জিপিও ৪.৫ বা এর নিচে এদের গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষায় বসার জন্য সিলেক্ট হওয়া প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ৪.৭ পাওয়া শিক্ষার্থীও পরীক্ষায় বসতে পারবে কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।ফলে এসব মেধাবীরা এবার বঞ্চিত হবেন নিজের মেধা প্রমাণ করতে।
এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে না পেরে দ্বিতীয় বার আবারও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার জন্য তারা সারাবছর অনেক পরিশ্রম করেন। ঢাবি, রাবি, চবিতে সেকেন্ড টাইম না থাকায় এসব শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগেরই মেইন টার্গেট এবার গুচ্ছ এক্সাম।
এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেরই উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল আশানুরূপ নয়। যার ফলে সিলেকশন করলে এসব শিক্ষার্থী গুচ্ছ পরীক্ষায় বসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তাহলে এসব শিক্ষার্থীরা গত একবছর ধরে যে পরিশ্রম করলো এর কোন ফলাফল পাবে না? এদের জীবন থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ একটা বছর নষ্ট হয়ে গেলো এর মূল্য কি নীতিনির্ধারকেরা দিবেন?
এছাড়া গত একবছর ধরে যারা বিভাগ পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিয়েছিলো তাদেরও স্বপ্নে ভাঙণ দেখা দিয়েছে। কারণ বিভাগ পরিবর্তনের জন্য তারা গত এক বছরে যেসব বিষয় পড়ে এসেছে তা সবই বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এখন সাইন্স থেকে কেউ বিভাগ পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে সাইন্সের সাবজেক্টেই পরীক্ষা দিতে হবে। কেউ কমার্স থেকে বিভাগ পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে কমার্সের সাবজেক্টেই পরীক্ষা দিতে হবে।
এর ফলে এসব শিক্ষার্থীদের পুরোবছরের প্রিপারেশন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ভর্তি পরীক্ষার সময় গুলোতে শিক্ষার্থীরা এমনিতেই প্রচুর মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। তার মধ্যে হুটহাট নতুন নতুন সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদেরও চিন্তার সীমা নেই।
শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা এখন সিলেকশন পদ্ধতির বাতিল চান। তারা চান সকলেই যেনো পরীক্ষায় বসে নিজের মেধা প্রমাণের একবার সুযোগ পান। শিক্ষায় সকলেরই সমান অধিকার আছে। সকলেরই অধিকার আছে নিজের মেধা প্রমাণের একবার সুযোগ পাওয়ার। কতৃপক্ষের উচিত লাখ লাখ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কথা চিন্তা করে অতিসত্বর এ পদক্ষেপ থেকে সরে আসা। কতৃপক্ষকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ রইলো এবং এরকম একটি প্রহসনমূলক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ করা হলো।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়