১০০ বছরেও ঢাবির অনার্স-মাস্টার্সের উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়নি

  © টিডিসি ফটো

প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) পি জে হার্টগ নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বিষয়ে কয়েকটি নিয়ম চালু করেছিলেন। যেমন অনার্স এবং মাস্টার্সের সকল ফাইনাল পরীক্ষার উত্তরপত্র দুইজন শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা। দুইজন পরীক্ষকের নম্বরে শতকরা ১০ নম্বরের বেশি পার্থক্য হলে সেটি আবার তৃতীয় পরীক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা।

এরপর মৌখিক পরীক্ষার নিয়মও তিনি চালু করেন। এছাড়া সারা বছর টিউটোরিয়াল ক্লাস এবং তার ফলাফলও মূল্যায়িত হতো। মৌখিক পরীক্ষার সময় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানো হতো। শুধু তাই না প্রশ্নপত্রে একটি প্যাটার্ন ফলো করা হতো যেমন ৮টি প্রশ্নের মধ্যে ৫টি উত্তর দিতে হবে। শুধু তাই না। প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষকরা অন্য বিভাগের প্রয়োজন অনুসারে অনার্স বিষয়ের বাহিরে কিছু "subsidiary" বা সহায়ক ক্লাস পড়ানোর নিয়ম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন তার ১০০তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে। এই ১০০ বছরে বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে এখন নর্দমায় পরিণত হয়েছে কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসব নিয়ম মোটাদাগে কোন পরিবর্তন না করেও নর্দমায় পরিণত হয়েছে। কিভাবে হয়েছে? তাহলে শুনুন তার গল্প। যেই নিয়ম বা সিস্টেম সময়ের সাথে যুগোপযোগী করে পরিবর্তিত না হয় সেই সিস্টেম ব্যর্থ হতে বাধ্য।

শুরুতে উত্তরপত্র ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য শিক্ষকদের কোন আলাদা পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। এক সময় দেওয়া শুরু হয় এবং সময়ের সাথে এর পরিমান বাড়তে থাকে। আবার subsidiary ক্লাস নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে কোন আলাদা পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। এসব কাজকে চাকুরিরই একটি অংশ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সব পাল্টে যায়। দিন যতই যেতে থাকে নানা অজুহাতে নানা ফন্দি-ফিকির করে এসব কাজের সাথে অর্থ সংযোগ ঘটানো হয়।

এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্য বিভাগে পার্ট-টাইম শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ নিয়ে subsidiary বিষয় পড়াচ্ছেন। ধান্দাবাজির একটা সীমা আছে! যেইটা একসময় ছিল কর্তব্যের মধ্যে সেটাকে এখন বানিয়ে ফেলা হয়েছে ইচ্ছের মধ্যে। আমরা শিক্ষকরা এইসব ছন্দাই নন্দাই করে কি আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পেরেছি? সমাজে নিজেদের মান সম্মান বাড়াতে পেরেছি?

পৃথিবীতে কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর উত্তরপত্র একাধিক শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা হয় না। উত্তরপত্র দুজন শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়নে কিছুটা লাভ আছে কিন্তু বড় পিকচারে লাভ ক্ষতি বিবেচনা করলে ক্ষতিই বেশি। সারা পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কিভাবে গবেষণায় আরো বেশি সময় দেয়াও যায় সেই চিন্তা করে। করে বলে যারা বেশি গবেষণা করে তাদের শ্রেণিকক্ষে ক্লাসের লোড কমিয়ে দেওয়া হয়, ল্যাবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, পার্ট-টাইম ও adjunct শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় যাতে শিক্ষকদের গবেষণা খাতে সময় বরাদ্দ বাড়ানো যায়।

সেজন্যই অধ্যাপকের পরীক্ষার উত্তরপত্র টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়েও দেখানো হয়। সেখানে দ্বিতীয় পরীক্ষক দিয়ে মূল্যায়নেরতো প্রশ্নই আসে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমরা যে কেবল শিক্ষকদের সময় নষ্ট করছি তাই নয় একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকার অপচয়ও হচ্ছে। তাছাড়া সেশনজ্যামের জন্য এটাও অনেকাংশে দায়ী। যেই কারণে আমরা দ্বিতীয় তৃতীয় পরীক্ষক নিয়োগ দেই সেইটা ভয়াবহ। সেইটা হলো আমরা শিক্ষকদের বিশ্বাস করি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) পি যে হার্টগ সাহেব ব্রিটিশ মানুষ ছিলেন। তিনি বাঙালিদের বিশ্বাস করেননি ঠিক আছে। ১০০ বছরে আমরা কেন বিশ্বাস করার মত শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলাম না। আমাদের সিস্টেম বরং এমন করা উচিত যে কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করলে চাকুরিচ্যুত। সেখানে কে কোন রাজনীতি করে দেখা হবে না। সমস্যাটা সেই জায়গায়।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ