শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি দেশের উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। একটি দেশের উন্নতি, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়- মুক্ত চিন্তা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পীঠস্থান।
আর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন কারা? বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দুই ধরনের ভাগ রয়েছে- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তথা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালসমূহের মধ্যে কিছু পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসিত আবার কিছু আধা স্বায়ত্বশাসিত। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর ভর্তি যুদ্ধে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংখ্যার বিপরীতে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।
একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পেছনে তাঁর স্বপ্ন, একটি পরিবারের স্বপ্ন এবং একটি দেশ ও জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা জড়িত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সমাজ একটু অন্য চোখে দেখে। তাদেরকে সবাই স্নেহ করে, সম্মান করে। তাদের ওপর সবার ইতিবাচক আশা- তারাই আগামীর সোনার বাংলা গড়ার কারিগর।
কিন্তু পরম দুঃখ ও হতাশার বিষয় হলো যখন একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী একজন লাইনম্যানের ছুরিকাঘাতে প্রাণনাশের শিকার হন, লাঞ্ছিত হন। সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে। প্রথমেই আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুর দেড়টার দিকে রূপাতলী বিআরটিসি বাস কাউন্টারে সামনে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। ছুরিকাঘাত করা ওই লাইনম্যানের নাম মো. রফিক। তিনি বরিশাল-আমুয়া রুটে লাইনম্যান হিসেবে রূপাতলী বিআরটিসির বাস কাউন্টারে কাজ করেন।
হামলার শিকার হওয়া ওই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র জিএম তৌফিকুল সজল। এসময় তার সঙ্গে থাকা অর্থনীতি বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ফারজানা আক্তারকে লাঞ্ছিত করেন বিআরটিসি বাস কাউন্টারের স্টাফরা।
জানা যায়, যশোরে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য দুপুর ১টার দিকে শহরের রূপাতলী বিআরটিসি বাস কাউন্টারে যান সজল। তাকে বাসে উঠিয়ে দিতে সঙ্গে যান সহপাঠি ফারজানা আক্তার। টিকিট কেটে সজল ও ফারজানা বিআরটিসি বাস কাউন্টারে অপেক্ষা করছিলেন। এসময় ভান্ডারিয়াগামী একটি বিআরটিসি বাস এসে থামে। লাইনম্যান রফিকের কাছে বাসটি কোথায় যাবে জানতে চাইলে সজলকে গালি দেন তিনি।
এনিয়ে তাদের সঙ্গে লাইনম্যান রফিক ও বিআরটিসি বাস কাউন্টারে থাকা অন্যদের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয়। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে রফিক পাশের ফলের দোকান থেকে ছুরি নিয়ে এসে সজলকে আঘাত করেন। এসময় তাকে উদ্ধারে সহপাঠী ফারজানা এগিয়ে এলে তাকে লাঞ্ছিত করে রফিকসহ কাউন্টারের স্টাফরা। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেন। পরে পুলিশের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধ ঘোষণা করে।
কিন্তু এর পরই ঘটে আরো বিভৎস ও জঘন্যতম ঘটনা! ওই ঘটনার জের ধরে মঙ্গলবার মধ্যরাত তথা বুধবার দিবাগত রাতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের মেস ও আবাসিক বাসায় ঢুকে তাদের উপর নির্মম হামলা চালায় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। অনেকেই ভয়ে বাঁচার আকুতি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেয়। বিষয়টি শুনে গায়ের লোম শিওরে উঠলো।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত, লাঞ্ছিত এবং রাতের অন্ধকারে বাসায় ঢুকে মারার মতো সাহস এরা কোথায় থেকে পায়? এদের পেছনের শক্তি কারা?
করোনা অতিমারির এই সময়টাতে করোনা প্রকোপ ঠেকাতে যখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখন শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে আসে। ফলে তাদের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সবই তাদের ভাড়া বাসায় রেখে আসে। কিন্তু কয়েকমাস পর গিয়ে দেখে তাদের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র বাড়িওয়ালা চুরি করে নিয়ে গেছে, অনেকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
দেখা যায়, এগুলো নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করতে গেলে তারা অনেক প্রকার হামকি দুমকীর শিকার হয়। এমনও ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভাড়া বাসায় থাকা শিক্ষার্থীদের জিনিসপত্র চুরি হয়েছে। আর এটাতে জড়িত ছিলেন শিক্ষক।
অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম, অপশাসন, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে- এটা ছাত্রসমাজের পবিত্র দায়িত্ব। যে ছাত্রসমাজ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো দেশ রক্ষার আন্দোলনে দেশপ্রেমের মহান ব্রত নিয়ে জীবন বাজি রেখে অধিকার আদায়ে আন্দোলন করে গেছেন-সে ছাত্রসমাজ কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে পারে না। এদেশের ছাত্রসমাজ একতাবদ্ধ হলে, তারা চাইলেই যেকোনো কিছুতেই পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এদেশের ছাত্রসমাজ কতটা শক্তিশালী তা সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন গুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞানীগুণী তৈরির আশ্রম। একজন মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত এবং তার মনুষ্যত্বের বিকাশে সাহায্য করে বিশ্ববিদ্যালয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর উপর একটি পরিবারের স্বপ্ন, সমাজ-রাষ্ট্রের আশা আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে থাকে। কেননা আজকের এই শিক্ষার্থীরাই আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব হাতে নেবে।
বর্তমান নেতৃত্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে- নেতৃত্বে তারুণ্যের সংখ্যা আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে, দিনদিন বেড়েই চলছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু বিকাশ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যদি অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর উপর হামলা করে, নির্যাতন চালায় তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা এবং অতি দ্রুত শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এর জন্য যদি প্রচলিত আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হয় তাও সহসা করতে হবে।
অপরাধী যেই হোক বা যে দল মতের হোক না কেন তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধীর বিশেষ কোনো পরিচয় নেই। অপরাধীর গায়ে যখন অপরাধের দাগ লেগে যায় তখন তার আর কোনো পরিচয় থাকে না। তখন তার একমাত্র পরিচয় পরিচয় সে অপরাধী। অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া, বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার সংস্কৃতি থেকে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলে। ফলে অপরাধী একের পর এক অপরাধ করে চলে। কেননা তার শাস্তির ভয় নেই। অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
আমরা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো এমন আর কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই এদেশের ছাত্রসমাজ নিরাপদে থাকুক, নির্বিঘ্নে চলুন, আলোকিত জীবন গড়ুক। সর্বোপরি দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে কাজ করুক।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়