কলিকাতা হারবালে বিশ্বাসী জাতির ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাস্থা কেন?

বাংলাদেশে বুধবার প্রথম টিকা নেন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা
বাংলাদেশে বুধবার প্রথম টিকা নেন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শেষে যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনুমোদনের অপেক্ষায় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো; তখনই বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে তারা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন কিনবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হয়ে‌ সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে করোনা ভ্যাকসিন সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন করে।

বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। পুনে শহরে ১০০ একরের বেশি জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৫০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করে। যার মধ্যে রয়েছে- পোলিও, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হাম, হেপাটাইটিস বি এবং রুবেলার ভ্যাকসিন। এগুলো বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।

করোনাভাইরাসের জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট নিজেরা কোনো ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেন নি বরং তারা অ্যাস্ট্রোজেনিকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ করছে। অ্যাস্ট্রোজেনিকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ সুবিধা এবং কম মূল্যের কারণে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং সকলের আস্থা অর্জন করে। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বেশ কিছু জরীপে কিছুটা ভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে। যার পিছনে রয়েছে বেশ কিছু নিয়ামক।

মো. জাহিদ হাসান

সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী এবছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে পরবর্তী ছয় মাসে ৫০ লাখ করে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সেই অনুযায়ী ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধও করা হয়। কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ ভারতের এনডিটিভিতে সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদার পুনাওয়ালা জানান ভারত সরকার এখনো ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমতি দেয়নি। ফলে ভ্যাকসিন পেতে আরো কয়েক মাস লেগে যাবে বাংলাদেশের। সীমান্ত ইস্যু, নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে ভারতের প্রতি নাখোশ বাংলাদেশের মানুষ এ খবরে ফুঁসে উঠে, মিডিয়াগুলো সরব হয়ে উঠে। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আলোচনা করে পরবর্তীতে বিষয়টি সমাধান করে।

গত ১৮ জানুয়ারি হঠাৎ করেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় তারা উপহার হিসেবে অ্যাস্ট্রোজেনিকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের ২০ লাখ ডোজ বাংলাদেশকে দেবে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের নিজেদের টাকায় কেনা ভ্যাকসিন যারা দিতে চায় না তারাই কিনা ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে দেবে! বিষয়টা বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বাভাবিক ঠেকেনি।

এরই মধ্যে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায় ভারত বায়োটেক তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত করোনা ভ্যাকসিন ‘কোভ্যাক্সিন’-এর ট্রায়াল চালাতে চায় বাংলাদেশে। এই ভ্যাকসিনটি নিয়ে খোদ ভারতেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা আছে এবং এর পার্শপ্রতিক্রিয়া অভিযোগও আছে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে থাকা অবস্থাতেই ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক মানুষের জন্য জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয় ভ্যাকসিনটি। যা নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টেও তীব্র সমালোচনা হয়। দিল্লির কয়েকটি হাসপাতালের ডাক্তাররা এই ভ্যাকসিন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।

ভারত সরকারের উপহার হিসেবে প্রদত্ত করোনা ভ্যাকসিন এবং ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিন বাংলাদেশের ট্রায়ালের খবর একই সময়ে মানুষের সামনে আসায় সকলের মনে ধারণা তৈরি হয় উপহার হিসেবে প্রদত্ত ভ্যাকসিনগুলো হয়তো ভারত বায়োটেকের এবং এগুলোর ট্রায়ালের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বারবার করে জানানো হয়েছে, এটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনিকা উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড। তবে সাধারণ জনগণ এই কথাতে আস্থা রাখতে পারছে না।

বিশ্বের অনেক দেশেই করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন গ্রহণে সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বড় বড় কর্মকর্তারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন। যেমনটা আমরা দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ অনেকের ক্ষেত্রেই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এরকম কেউ ভ্যাকসিন গ্রহণ করেনি। ফলে সাধারণ জনগণ ভ্যাকসিনের প্রতি বিরূপ ধারণা রাখছে।

মহামারি করোনা থমকে দিয়েছে আমাদের জীবনকে, অনেক কার্যক্রমই এখনো স্বাভাবিক হয়নি, দেশের অর্থনৈতিক ধারা কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে। আর এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হিসেবে আশার আলো দেখাচ্ছে করোনা ভ্যাকসিন। তাই ভ্যাকসিনের প্রতি জনগণের বিরূপ ধারণা পরিবর্তন খুবই জরুরি ।

এ বিষয়ে সরকারকে পালন করতে হবে মুখ্য ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি কিংবা দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিজেরা ভ্যাকসিন গ্রহণ করার মাধ্যমে জনগণকে আস্থা প্রদান করতে পারেন। ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করে, ভ্যাকসিন গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা মিডিয়ায় প্রচার করে জনগণকে সচেতন করতে হবে। ডাক্তার, গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট, নার্সসহ সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সফল হবে করোনা ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম, সচল হবে দেশের অর্থনীতি, প্রত্যেকে নেমে পড়বো নিজ কর্মক্ষেত্রে এমনটাই আশা রাখি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ